
যে কয়েকটি পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কুমিল্লাকে পরিচিত করে তুলেছে, তার একটি বিজয়পুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শত বছরের পুরোনো এই মৃৎশিল্পে এসেছে নান্দনিকতা। মানুষের রুচির পরিবর্তন ও চাহিদা মাথায় রেখে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন মাটির পণ্য।
মৃৎশিল্পীদের ভাষ্য, এই শিল্পে সবচেয়ে বড় সমস্যা গ্যাস–সংকট। এ কারণে প্রায় ৯ বছর ধরে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর সমাধান করা গেলে নতুন করে আরও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি বাড়বে।
চারদিকে সবকিছু প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের ভিড়ে মৃৎশিল্পের প্রসার ও ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। তবে সংকটের কারণে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে এরই মধ্যে পেশা ছাড়ছেন অনেক কুমার। যদিও হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এখনো চেষ্টার কমতি নেই মৃৎশিল্পীদের।
মৃৎশিল্পীরা জানান, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর ও আশপাশের এলাকায় মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য শত বছরের পুরোনো। কয়েক দশক আগেও বিজয়পুর এলাকার সাতটি গ্রামের আট শতাধিক পাল সম্প্রদায়ের মানুষ মাটির হাঁড়ি–পাতিল তৈরি করতেন। বর্তমানে তেগুরিয়াপাড়া, গাঙকুল, দক্ষিণ বিজয়পুর, উত্তর বিজয়পুর, বারপাড়া, দুর্গাপুর ও নোয়াপাড়া–এই সাত গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পে যুক্ত। এর মধ্যে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতিতে যুক্ত আছে অন্তত ৫০টি পরিবার।
কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া বারপাড়া গ্রামে সম্প্রতি প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা। কুমারেরা কাঠের চাকায় কাঁচা মাটি ঘুরিয়ে তৈরি করছেন নানা ধরনের পণ্য। আরেক দল সেসব পণ্য রোদে শুকাতে দিচ্ছে। কেউ আবার শুকানোর পর পণ্য এনে জড়ো করছেন আগুনে পোড়ানোর জন্য। আগুনে পোড়ার পর এসব পণ্য বিক্রির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়। বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির মাধ্যমে বিভিন্ন মাটির জিনিসপত্র তৈরি করেন কুমারেরা। টেরাকোটা শোপিসের পাশাপাশি তৈরি করা হয় হাঁড়ি-পাতিল, ফুলদানি, বাটি, মগ-জগসহ নান্দনিক সব পণ্য।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে কাজ করছেন ষাটোর্ধ্ব মৃৎশিল্পী পরিমল পাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আধুনিকতার সঙ্গে এখন অনেকে মেশিনের চাকায় পণ্য তৈরি করেন। তবে আমি ৩৫ বছর ধরে হাতে ঘোরানো কাঠের চাকা ঘুরিয়ে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করি। দৈনিক ৫০০ টাকা হাজিরা পাই।’ মৃৎশিল্পকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক নারীর। আবেদা বেগম নামের এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাটির পণ্যে নকশা ও ফিনিশিংয়ের কাজ করি। মাসে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত একজন নারীর বেতন হয়।’
স্থানীয় মানুষেরা জানান, ১৯৯১ সালে বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি গ্যাস–সংযোগ পায়। ২০১৫ সাল থেকে গ্যাসের চাপ কমে যায়। ২০১৭ সালের দিকে চাপ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এর পর থেকে গ্যাস নেই বললেই চলে। গ্যাস–সংকটের কারণে লাকড়ি দিয়ে মাটি পোড়ানোর কাজ করতে হচ্ছে। এতে কিছু কিছু পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অরুণ চন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাস–সংকটের কারণে পর্যাপ্ত উৎপাদন করতে পারছি না। এখনো দেশ-বিদেশে বিজয়পুরের মাটির পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাপান, কানাডা, আমেরিকা, আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আমাদের পণ্য।’
কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বিজয়পুরের মৃৎশিল্প কুমিল্লার শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। একসময় মাটির পণ্যগুলো ভালোভাবে বাজারজাত করতে পারছিলেন না কুমারেরা। তখন সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ ও কুমিল্লা বার্ডের (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল যুবকদের সংগঠন প্রগতি সংঘের ১৫ জনকে নিয়ে গড়ে তোলেন বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি। এই মৃৎশিল্প ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু সেটি এখনো হয়নি।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এরই মধ্যে কুমিল্লার রসমালাই ও খাদি জিআই পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিজয়পুরের মৃৎশিল্প জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।’
গ্যাস–সংকট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিব) মো. এনামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘সেখানে গ্যাস–সংযোগ থাকলেও আমাদের গ্রাহক বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এরপরও তাঁরা বাখরাবাদে এসে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারেন। আমরাও দেখছি, কী করা যায়।’