বাড়ির উঠোনে চৌবাচ্চায় কাজ করছেন মমতাজ আক্তার। চালুনি দিয়ে জৈব সার বের করছিলেন। সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে
বাড়ির উঠোনে চৌবাচ্চায় কাজ করছেন মমতাজ আক্তার। চালুনি দিয়ে জৈব সার বের করছিলেন। সম্প্রতি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে

মমতাজের ছিল অভাবের সংসার, এখন মাসে আয় ৭০ হাজার টাকা

বিয়ের পর মমতাজ আক্তার জানতে পারেন, তাঁর স্বামী বেকার। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখেন, থাকার ঘরও নেই—বৃষ্টির দিনে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে, বেড়ায় পলিথিন টাঙানো। এমন দুর্দিনে একসময় তাঁদের সংসার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়, শুরু হয় অভাব-অনটনের সঙ্গে নিত্য বসবাস।

সেই মমতাজ এখন সফল উদ্যোক্তা। ভার্মি কম্পোস্ট বা জৈব সার তৈরি করে বদলে ফেলেছেন নিজের ভাগ্য। জরাজীর্ণ ঘর থেকে এখন তিনি আধা পাকা বাড়ির সঙ্গে ৫ শতাংশ বসতভিটা ও তিন বিঘা জমির মালিক। আছে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ একটি সমন্বিত কৃষি খামার—সেটির নাম দিয়েছেন ‘মেসার্স আলিফ সমন্বিত কৃষি খামার’। এসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রংপুর বিভাগে ‘সফল আত্মকর্ম’ ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি জাতীয় যুব পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

মমতাজ আক্তারের (৩৩) বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দরবস্ত ইউনিয়নের কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে। গতকাল সোমবার বিকেলে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, মমতাজের কর্মযজ্ঞ। বাড়ির উঠানে চৌবাচ্চায় ভর্তি জৈব সার। মমতাজ একটি চৌবাচ্চা থেকে চালুনি দিয়ে জৈব সার বের করছেন। এসবের ফাঁকে গৃহপালিত পশু-পাখিকে খাবারও দিচ্ছিলেন। এসব কাজে তাঁকে সহায়তা করছিলেন আরেক নারী।

পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে কালিতলা দুর্গাপুর গ্রামের বেলাল হোসেনের সঙ্গে একই উপজেলার বড় জামালপুর গ্রামের মশিউর রহমানের মেয়ে মমতাজ আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বেকার থাকলেও মমতাজের প্রচেষ্টায় বেলাল বর্তমানে ভাঙারি ব্যবসা করছেন। তাঁদের সংসারে একটি ছেলে আছে। এসব সামলে মমতাজ এইচএসসি পাস করেছেন। সম্প্রতি তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছেন।

রংপুর বিভাগে ‘সফল আত্মকর্ম’ ক্যাটাগরিতে সম্প্রতি জাতীয় যুব পুরস্কারে ভূষিত হন মমতাজ আক্তার

শুরুর কথা

মমতাজ আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৫ শতাংশ জমি ছাড়া স্বামীর আর কোনো সম্পদ ছিল না। অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটত তাঁদের। একসময় বাবার বাড়ি থেকে একটি গাভি এনে সংসারের হাল ধরেন মমতাজ। পরে গরুর সংখ্যা বাড়ে, দুধ বিক্রি করে ধীরে ধীরে সংসারের খরচ চালাতে শুরু করেন।

এরই মধ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের এক প্রশিক্ষণে অংশ নেন মমতাজ। সেখানে কেঁচো ও গোবর দিয়ে জৈব সার তৈরির পদ্ধতি শেখেন। বাড়িতে ফিরে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে স্বামী বেলাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরির কাজ। বগুড়া থেকে ৩০০ টাকায় ২০০ গ্রাম কেঁচো কেনেন তাঁরা। এসব কেঁচো একটি ছোট চৌবাচ্চায় ৩০ কেজি গোবরের মধ্যে ছেড়ে দেন। ২৫ দিন পর ২৫ কেজি জৈব সার উৎপাদন করা হয়। খরচ পড়ে ৩৬০ টাকা আর বিক্রি হয় ৭২০ টাকায়। প্রথম উদ্যোগেই দ্বিগুণ লাভ। এরপর বড় পরিসরে জৈব সার তৈরির উদ্যোগ নেন।

পরের বছর বাড়ির উঠোনে ৯টি বড় চৌবাচ্চা তৈরি করেন মমতাজ। আট কেজি কেঁচো ও সাত টন গোবর দিয়ে ৪০ দিনে তৈরি হয় ছয় টন সার। খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা, বিক্রি হয় ৬০ হাজার টাকায়। এখন এ খাতে প্রতি মাসে তাঁর আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাফল্য

জৈব সার উৎপাদনের আয় দিয়ে মমতাজ আক্তার বর্তমানে ৫টি গরু, ২২টি ছাগল, ৫০টি হাঁস ও ৪৩টি মুরগি কিনে লালন-পালন করছেন। গরুর দুধ বিক্রির পাশাপাশি ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন করে তাঁর মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ২১ হাজার টাকা। এ ছাড়া তিনি তিন বিঘা জমিতে ঔষধি, ফলদ ও বনজ গাছের চারা উৎপাদন করছেন। তাঁর নার্সারিতে এখন বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২০ হাজার গাছের চারা আছে। নার্সারি থেকে তাঁর মাসিক গড় আয় ২০ হাজার টাকা। এসব খাত মিলিয়ে মমতাজের মাসিক গড় আয় ৭০ হাজার টাকা।

মমতাজের স্বামী বেলাল হোসেন বলেন, ‘কৃষিকাজের ওপর মমতাজের আগ্রহ প্রচণ্ড। তাঁকে সব সময় উৎসাহিত করি। পাশাপাশি কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত মালামাল বিক্রিতে সহায়তা করি। তাঁকে নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।’

গৃহপালিত গরুকে খাওয়াচ্ছেন মমতাজ আক্তার

স্বাবলম্বী করেছেন আরও অনেককে

মমতাজের খামারে কাজ করছেন কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামের আটজন নারী। তাঁদের একজন আতিকা বেগম। তিনি বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। এখন এ কাজ করে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করেন। একই গ্রামের আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে দিনমজুর হিসেবে অনিশ্চিত জীবন কাটলেও এখন মমতাজের খামারে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।

মমতাজের কৃষি উদ্যোগের প্রশংসা করেন দরবস্ত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৩ নম্বর ওয়ার্ডের (কালীতলা দুর্গাপুর) সদস্য আল মামুন সরকার। তিনি বলেন, মমতাজ পরিশ্রম করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, এলাকার অনেককে স্বাবলম্বী করেছেন। তিনি এলাকায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

মাটির স্বাস্থ্য ও গুণ সুরক্ষার জন্য জৈব সারের বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রাসায়নিক সার কম বা বেশি হলে মাটির স্বাস্থ্য বা গুণ খারাপ হয়ে যায়। তবে জৈব সারে এই সমস্যা হয় না। জৈব সার ব্যবহার করলে পানি ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যায় ও তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা পায়। জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির ক্রিয়া-বিক্রিয়া সঠিক থাকে। এ ক্ষেত্রে মমতাজ আক্তার অনন্য ভূমিকা রাখছেন। তাঁকে পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

মমতাজ আক্তার নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি ১০ জন দরিদ্র নারীকে নার্সারি তৈরি করে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৪০ হাজার গাছের চারা বিতরণ করেছেন। কালীতলা দুর্গাপুর গ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘মমতাজ পল্লী উন্নয়ন যুব ক্লাব’। এই ক্লাবে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও নার্সারি বিষয়ে ২৫০ জন বেকার যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে মমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, ভবিষ্যতে তিনি বড় আকারে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলবেন। এ জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম করলে বেকারত্ব কোনো অভিশাপ নয়, যে কেউ সাফল্য অর্জন করতে পারে। আমি নিজেই তার প্রমাণ।’