কোনো রকম জোয়ারের পানি ঠেকানো গেলেও বাঁধের অন্যান্য অংশে ঝুঁকি রয়েই গেছে বলে মনে করেন স্থানীয় লোকজন। আজ শুক্রবার সকালে খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায়
কোনো রকম জোয়ারের পানি ঠেকানো গেলেও বাঁধের অন্যান্য অংশে ঝুঁকি রয়েই গেছে বলে মনে করেন স্থানীয় লোকজন। আজ শুক্রবার সকালে খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায়

দাকোপে বাঁধে ভাঙন

ঢাকী নদীর পানি আটকানো গেছে, এখন বড় চিন্তা ধান নিয়ে

বেড়িবাঁধ ভেঙে গত মঙ্গলবার রাতে খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ায় ঢাকী নদীর পানি হুহু করে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। উঠোন ছাপিয়ে পানি উঠে যায় প্রিয়া খাতুনদের ঘরে। খোরাকির জন্য রাখা ধান খাটে তুলে রেখে স্বামী ও ছোট সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় আশ্রয় নেন তিনি। পরদিন বাঁধের ওপরই তাঁবু খাটিয়ে বসবাস শুরু করেন।

চার দিন ধরে পরিবার নিয়ে বাঁধেই থাকছেন প্রিয়া খাতুন। কপালে জুটেছে কেবল শুকনো খাবার। দুই দিন পর বৃহস্পতিবার রাতে পানির বড় প্রবাহ আটকানো সম্ভব হয়েছে। আজ শুক্রবার সকালে পানি কিছুটা নামার পর অস্থায়ী চুলায় প্রথমবার ভর্তা আর ভাত রান্না করতে পেরেছেন প্রিয়া খাতুন। দুপুরে ওই বাঁধ দিয়ে আর জোয়ারের পানি ঢোকেনি।

পানি আটকানোয় আপাতত স্বস্তিতে এলাকার মানুষ। তবে মুখে দুশ্চিতার স্পষ্ট ছাপ। ধান নিয়েই যত চিন্তা। গত মঙ্গলবার রাতে বটবুনিয়া হরিসভা মন্দিরসংলগ্ন ঢাকী নদীর বাঁধ ভেঙে বটবুনিয়া গ্রাম ও নিশানখালী বিলে পানি ঢুকে পড়ে। বাঁধ ভাঙার কারণে ওই এলাকার প্রায় ২ হাজার ২৩১ বিঘা জমির আমন ধান পানিতে তলিয়ে যায়। গ্রামজুড়ে এখন সবচেয়ে বড় আলোচনা—ধানের কী হবে?

প্রিয়া খাতুন বলেন, ‘তিন বিঘা জমি করেছিলাম। ধান পাটায়ে (নুইয়ে) গেছে। গাছের গোড়ার এক বিঘত (৯ ইঞ্চি) বালি। ওই ধান আর বড় হবে কি না আল্লাহপাক জানে। গাছ বড় হলেও হয়তো ধানে চিটা হয়ে যাবে। গত বছর পানখালী ভেঙে গেলে ওদের তাই হয়েছিল। আমরা তবু রাস্তায় উঠে থাকতি পারতিছি। ধানগাছ তো আর ঠেকাতি পারলাম না। ভালো বাঁধ থাকলে এত বড় ক্ষতি তো হইত না।’

প্রিয়া খাতুনদের তাঁবুর ঘরে বসে ছিলেন আরও কয়েকজন নারী। তাঁদের একজন ফিরোজা বেগম বলেন, ‘বাড়তি কোনো ইনকাম নেই এখানকার মানুষের। এই একটা ফসলেই ভরসা। এই ধান খেয়ে ও বিক্রি করে সংসার চলে। আগামী একটা বছর কী হবে, সেটা নিয়েই চিন্তা। বাঁধটা যদি এক দিন আগেও বাঁধা যেত। ফসলের ক্ষতি এত হতো না। আমাদের ত্রাণ, এই চিড়ে, মুড়ি, গুড়ের দরকার নেই ভাই। আমাদের স্থায়ী বাঁধ দরকার। বছর বছর ভাইসে আর পারা যায় না।’

আজ শুক্রবার সকালেও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বালু ও জিও টিউব দিয়ে বাঁধ শক্ত করার কাজ চালাচ্ছিল। পাশে স্বেচ্ছাশ্রমে বালুর বস্তা মাথায় নিয়ে বাঁধের পাশে ফেলছিলেন ৩০-৩৫ জনের একটা দল। শিউলি সরদার, মালবিকা মণ্ডল, মাধুরী সরদারসহ ওই দলের বেশির ভাগই নারী।

মাথায় বালুর বস্তা নিয়ে বাঁধ ফেলে ফেরার পথে কথা হয় মাধুরী সরদারের সঙ্গে। সচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ মাধুরী বলেন, রান্নাঘর গেছে, ঘরের বারান্দা ধসে গেছে। আড়াই লাখ টাকা ইজারায় ধান করেছিলেন, সব ডুবে গেছে। মাছের ঘের শেষ, হাঁস-মুরগি গাছে উঠিয়ে রাখছেন। রান্নাবান্না বন্ধ। নিজেরা বাঁচার জন্যই মাথায় করে বালি ফেলছেন। স্থায়ী সমাধান দরকার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশাপাশি স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ শক্তিশালীকরণের কাজে যোগ দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আজ শুক্রবার সকালে খুলনার দাকোপের বটবুনিয়ায়

বটবুনিয়া বাজারে বসে অসীম সরদার বলেন, ‘এখন ধানে থোড় হওয়ার সময়। এই সময় পানি কম রাখতে হয়। অথচ পানিতে ডুবে গেল। এবার ভেবেছিলাম ধান ভালো হবে। কিন্তু এই একটা চাপ পড়ে গেল। পানি এখন সরছে বটে, তবে নিচু জমিতে পানি তাড়াতাড়ি সরবে না। নিচের দিকের জমির ধানে বেশি ঝামেলা হবে। এরপরও প্রচুর সার লাগবে, কীটনাশক লাগবে। শেষ পর্যন্ত ফসল কেমন হবে সেটা বড় চিন্তার বিষয়।’

চার বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন বটবুনিয়া গ্রামের প্রকাশ বালা। এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে ৩৫ হাজার টাকার কিছু বেশি। বেড়িবাঁধের ওপর বিমর্ষ মুখে বসে প্রকাশ বলেন, ‘ধান এবার আর হবে না। সকালে ধাতখেতে গিয়েছিলাম। ধানগাছের গোড়ায় আট-দশ ইঞ্চি বালি। ওই গাছ যদি বাঁচেও, ধান ভালো হবে না। ভাঙনের কাছাকাছি আমরা যারা, তাদের বড় রকমের ক্ষতি হয়ে গেল।’

ভাঙনের পাশে দাঁড়িয়ে অখিল সরদার বলেন, ‘আমার রন্নাঘর, থাকার ঘরের মেঝে, বাথরুম সব বালুতে ঢেকে গেছে। আমার ঘরের পেছনে কৃষ্ণপদ সরদার আর গৌতম ঢালীর জমির প্রচুর ধান পুরোটাই বালির নিচে। গত মাঘে একবার ভাঙল। আবার এখন ভাঙল। সারা বছর এভাবেই চলছে। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়।’

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, এখন তো মাটি পাওয়া যায় না। শুধু বালুর বাঁধ। ছোট ছোট বালুর বস্তা আসলে কাজে আসে না। গতবার ভাঙার পর যে বস্তা দিয়েছিল তা ভেসে গেছে। আগে ভাঙনে বাঁশের খাঁচা দেওয়া হতো, তার মেধ্যে আধভাঙা ইট। সেটা মোটামুটি টেকসই ছিল। ভাঙনে চর পড়ত।

গ্রামের আরেকজন বাসিন্দা অমল কৃষ্ণ গাইনের মতো অনেকের অভিযোগের তির পানি উন্নয়ন বোর্ডের দিকেই। অমল কৃষ্ণ বলেন, কোনো তদারকি নেই। তাঁদের (পাউবো) গাফিলতি বলার মতো না। বরাদ্দ ঠিকই হয় কিন্তু জায়গামতো তা পৌঁছায় না। ইউনিয়নে আন্ধারমানিক গ্রামে আজ রাতে বড় ভাঙন ধরেছে। যত দিন যাচ্ছে রাস্তাঘাট ভয়াবহ হয়ে যাচ্ছে। টেকসই বাঁধ না হলে আর টিকে থাকতে পারছেন না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা পানি উন্নয়ন বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই পানির বড় প্রবাহ আটকানো গিয়েছিল। এরপরও উপচে কিছু পানি ঢুকছিল। আজ শুক্রবার দুপুরের মধ্যে পুরোপুরি পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। এখন বাঁধ আরও শক্তিশালী করার কাজ চলছে। এ ছাড়া ভাঙনের ওই জায়গায় আরও কিছু দুর্বল অংশ আছে। এ জন্য পেছন দিয়ে ৩৫০ মিটার রিং বাঁধ করা হবে।

তাৎক্ষণিক মেরামতের বদলে স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে আশরাফুল আলম বলেন, এই পোল্ডারের জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে ২২ কিলোমিটার নদীশাসন, পুনর্বাসন এবং বাঁধ নির্মাণ করার এটি যদি অনুমোদন হয়, তাহলে এই পোল্ডারের যে সমস্যা আছে, তা সমাধান হবে।