সুনামগঞ্জের স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রোগীদের প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ করে দিয়ে আনন্দ পান তরুণ তৈয়বুর রহমান। পাঁচ বছর ধরে এই কাজে যুক্ত তিনি
সুনামগঞ্জের স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রোগীদের প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ করে দিয়ে আনন্দ পান তরুণ তৈয়বুর রহমান। পাঁচ বছর ধরে এই কাজে যুক্ত তিনি

একাই মাসে শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তৈয়বুর

সুনামগঞ্জে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে, তাঁদের একজন তৈয়বুর রহমান (২৬)। তিনি নিজে নিয়মিত রক্ত দেন, রক্ত সংগ্রহ করে দেন এবং মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। রক্তের টানে মানুষের পাশে দাঁড়ানোতেই তাঁর আনন্দ।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রক্তদানের এই মানবিক কাজকে নিজের করে নিয়েছেন তিনি। কয়েক বছর আগে একাই মানুষের জন্য রক্ত জোগাড় করতেন। এখন তিনি ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জ নামের স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ফলে কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ। মাসে একাই শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আড়াই হাজারের বেশি রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে আছে প্রায় এক হাজার রক্তদাতার ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও যোগাযোগের তালিকা। সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও সংগঠকেরাও তাঁকে সহযোগিতা করেন।

তৈয়বুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। তিনি ইসলামী ব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। রক্তের প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, পরিবহন বা দৌড়ঝাঁপ—সবকিছুর ব্যয়ই মেটান নিজের স্বল্প বেতন থেকে।

রক্তদানের শুরুর স্মৃতি বলতে গিয়ে তৈয়বুর রহমান জানান, ২০২০ সালে তিনি তখন নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। এক সহকর্মীর অনুরোধে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য রক্ত দিতে ছুটে যান চাষাড়া এলাকায়। কিন্তু ওজন কম থাকায় রক্ত দিতে পারেননি। পরে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর জন্য আবার হাসপাতালে যান এবং এবার রক্ত দিতে সক্ষম হন। প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় ছিল তাঁর। পরে এটা কেটে যায়।

সুনামগঞ্জে বদলি হয়ে ফিরে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে থাকেন বলে জানান তৈয়বুর রহমান। নিজের এলাকায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার আয়োজন ও সচেতনতা ক্যাম্পেইনও করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন। অধিকাংশই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য। ঈদের দিনও রক্ত দিয়েছেন তিনি। জেলা সদর হাসপাতাল ও শহরের সব বেসরকারি ক্লিনিকেই তাঁর নম্বর আছে। কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো রোগীর জন্য উপযুক্ত রক্তদাতা খুঁজে বের করা।

তৈয়বুর রহমান বলেন, রক্তদানের পর কিছু পরিবার এখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, খবর নেয়। আবার কেউ কেউ রক্ত সংগ্রহে একটু দেরি হলে মনঃক্ষুণ্ন হন। কেউ রক্ত পেয়ে ধন্যবাদ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। তবু মন খারাপ করেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে তাহিরপুর উপজেলার এক প্রসূতি বোনকে রক্ত দিয়েছিলাম। এখনো ওই পরিবার যোগাযোগ রাখে। সময়-অসময় খোঁজ নেয়। এটা ভালো লাগে, এটা অন্য রকম রক্তের সম্পর্ক। এই কাজ করে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। যত দিন পারি, এই কাজ করে যাব।’

এখন পর্যন্ত ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন তৈয়বুর রহমান

তৈয়বুর রহমান সম্পর্কে ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জের সহপ্রতিষ্ঠাতা কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, ‘সে এক অসাধারণ ছেলে। তার নিজের কাজের মধ্যেই এই মানবিক কাজ গুরুত্ব দিয়ে করে। মানুষের পাশে দাঁড়ায়।’

সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদান বাড়ছে

৩০ বছর ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদানে যুক্ত আছেন সুনামগঞ্জ শহরের হাছননগর এলাকার বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলাম মজনু (৪৬)। তিনি এখন পর্যন্ত ৬০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। গত ১৪ অক্টোবর জেলা সদর হাসপাতালে তাঁর ৬০তম রক্তদানের সময় উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাহবুবুর রহমান।

মুজাহিদুল ইসলাম জানান, আগে শুধু সন্ধানী ডোনার ক্লাব রক্তদানের কাজ করত। এখন আরও কয়েকটি সংগঠন ও অনেক তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছেন। সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদান অনেক বেড়েছে। তবে এখানে একটি ব্লাড ব্যাংক খুব জরুরি।

সুনামগঞ্জে বর্তমানে সন্ধানী ডোনার ক্লাব, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বাঁধন, ব্লাড লিংক, খিদমাহ, বিশ্বজন, আলোসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা স্বেচ্ছায় রক্তদান, নতুন রক্তদাতা তৈরি ও রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের কাজ করেন।

জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে কোনো ব্লাড ব্যাংক নেই। তবে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা রয়েছে।

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি প্রতি তিন মাস পর প্রয়োজনে রক্ত দিতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। একসময় বিষয়টি সম্পর্কে মানুষ সচেতন ছিলেন না। এখন মানুষ সচেতন। তাই সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংখ্যা বেড়েছে।