কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সপ্তম সম্মেলনে প্রতিনিধিরা। গতকাল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে
কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সপ্তম সম্মেলনে প্রতিনিধিরা। গতকাল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সম্মেলন

‘সহযোগিতা চাই, সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ নয়’

  • ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় জোর অজিত দোভালের।

  • ভুল তথ্য ও গুজবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত পদক্ষেপ চায় বাংলাদেশ।

কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভকে ‘উন্মুক্ত আঞ্চলিকতাবাদের’ ভিত্তিতে একটি উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আঞ্চলিক বহুপক্ষীয় সংস্থা হিসেবে বিকশিত দেখতে চায় বাংলাদেশ। যেখানে নিরাপত্তা ফোরাম সনদের ভিত্তিতে পারস্পরিক আস্থা, সুবিধা ভাগাভাগি এবং কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সপ্তম সম্মেলনে দেওয়া সূচনা বক্তৃতা এবং নির্ধারিত সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য নির্ধারিত ভাষণে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সুষমা স্বরাজ ইনস্টিটিউট অব ফরেন সার্ভিসের সম্মেলন কক্ষে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।

স্বাগতিক দেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল সম্মেলনের শুরুতে বক্তৃতা করেন। অজিত দোভাল বলেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ। তাই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সমুদ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে সিএসসির গুরুত্ব আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিবেশের মধ্যে সিএসসি আজ বিরাট গুরুত্ব অর্জন করেছে।

দিল্লিতে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান (ডানে) ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (বাঁয়ে) করমর্দন করছেন

একটি উন্মুক্ত ও নীতিনির্ভর সামুদ্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে অজিত দোভাল বলেন, ‘একটি উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামুদ্রিক এলাকার বিকাশ এবং এর স্বার্থে আমাদের একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামুদ্রিক ক্ষেত্র গড়ে তুলতে এবং নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আমাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।’

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ভারত সিএসসির সদস্যদেশগুলো নিয়ে পরিবর্তনশীল এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের অভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

সূচনা বক্তৃতায় খলিলুর রহমান বলেন, ‘দিল্লির লালকেল্লায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি আমরা গভীর শোক ও সমবেদনা জানাই। আমরা এই জঘন্য ঘটনার নিন্দা জানাই। আমরা ইতিমধ্যে ভারত সরকারকে জানিয়েছি যে এই দুঃসময়ে ভারতীয় ভাইবোনদের পাশে বাংলাদেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রয়েছে।’

খলিলুর রহমান বলেন, ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ এবং এই সভাকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম হিসেবে বিবেচনা করে। বঙ্গোপসাগরের একটি উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি আমাদের পারস্পরিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরামের সনদের মূলনীতিতে বাংলাদেশের অটল থাকার বিষয়টি সূচনা বক্তৃতা ও সদস্যদেশের নির্ধারিত বক্তৃতায় তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে কনক্লেভের সেই মূল্যবোধ ও নীতিগুলো অনুসরণ করে, যা একটি স্বাধীন, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারত মহাসাগর নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত, যেখানে ভারত মহাসাগরীয় সম্প্রদায়ের সব সদস্যের যৌথ সমৃদ্ধি নিহিত। এই নীতিগুলো কনক্লেভের সনদে অন্তর্ভুক্ত সার্বভৌমত্ব, সমতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মূলনীতির ভিত্তিতে রচিত।

খলিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ সিএসসির পাঁচটি স্তম্ভের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয় এবং এসব অগ্রাধিকারের মাধ্যমে সম্মিলিত নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও যৌথ সমৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যের তাৎপর্য অনুধাবন করে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের সামুদ্রিক ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালনে অটল। জলদস্যুতা, অবৈধ মাছ ধরা, সামুদ্রিক সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ মোকাবিলায় আমরা মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। অতীতে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের কিছু চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশও মোকাবিলা করেছে। আমরা যেকোনো পরিস্থিতিতে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি “জিরো টলারেন্স” নীতি অনুসরণ করি।’

দিল্লিতে কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভের (সিএসসি) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সপ্তম সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান । আজ বৃহস্পতিবার দিল্লিতে
‘একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগর অঞ্চল নিশ্চিত করতে এবং আমাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অন্যদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করতে তৈরি বলে আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি। আমরা কোনো বহিরাগত বা অভ্যন্তরীণ শক্তিকে আমাদের সমাজের বা এর কোনো অংশের নিরাপত্তা ও কল্যাণকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিতে পারি না।
খলিলুর রহমান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের (মিসইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন) হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। আমরা নিজেদের সাইবারস্পেস, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও প্রযুক্তিকে সুরক্ষিত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ, যা শুধু নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থেই নয়। সাইবার নিরাপত্তা, ভুল তথ্য এবং গুজবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত পদক্ষেপগুলো স্পষ্টভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এ বিষয়ে সিএসসির পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছি। আঞ্চলিক নিরাপত্তার জটিলতা মোকাবিলায় আমরা পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান, অভিন্ন স্বার্থ এবং সুবিধা ভাগাভাগির নীতিতে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি।’

খলিলুর রহমান বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগর অঞ্চল নিশ্চিত করতে এবং আমাদের অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অন্যদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করতে তৈরি বলে আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি। আমরা কোনো বহিরাগত বা অভ্যন্তরীণ শক্তিকে আমাদের সমাজের বা এর কোনো অংশের নিরাপত্তা ও কল্যাণকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দিতে পারি না। সুতরাং আমরা পারস্পরিক বিশ্বাস ও উন্মুক্ততার ভিত্তিতে অভিন্ন সমস্যার যৌথ সমাধান খুঁজে পেতে সব সময় তৈরি থাকব।’ তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক বিশ্বাস ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যেকোনো বিষয়ে অভিন্ন সমাধান খুঁজে পেতে আমরা প্রস্তুত। বাংলাদেশ এই কনক্লেভকে একটি উন্মুক্ত আঞ্চলিকতাবাদ-চালিত, উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আঞ্চলিক বহুপক্ষীয় সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠার প্রত্যাশা করে।’

গতকাল বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সিএসসি সদস্যরাষ্ট্রগুলো চিহ্নিত সহযোগিতা–স্তম্ভের অধীনে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সহযোগিতা বাড়ানোর বিভিন্ন

উপায় নিয়ে আলোচনা করে। তারা সিএসসির দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। সদস্যদেশগুলো সেশেলস প্রজাতন্ত্রের ফোরামের পূর্ণ সদস্য হিসেবে যোগদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।

গতকালের সম্মেলনে আরও অংশ নেন মালদ্বীপের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইব্রাহিম লতিফ, মরিশাসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রাহুল রাসগোত্রা, শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষাসচিব সাম্পাথ থুয়াকোন্থা এবং সেশেলসের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মাইকেল রোসেট। এ ছাড়া ফোরামে প্রথমবারের মতো অতিথি হিসেবে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপমহাপরিচালক বাদরুল শাহ মোহাম্মদ ইদ্রিস।

ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আমন্ত্রণে সিএসসির সম্মেলনে যোগ দিতে গত মঙ্গলবার ঢাকা ছাড়েন খলিলুর রহমান। বুধবার সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় প্রধান ইস্যুগুলো নিয়ে অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে দেশে ফেরেন।