আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান
আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান

পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষা করে আমরা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে চাই

রাজধানীর পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে ‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’। পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার এই নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ৩৮ দিন ধরে পান্থকুঞ্জে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। এই প্ল্যাটফর্মের দুই সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের দাবি ও যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন

পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষায় আপনারা টানা এক মাসের বেশি সময় ধরে এই পার্কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন।

আমিরুল রাজিব: পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষার আন্দোলনের আগে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনেও আমরা সক্রিয় ছিলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে ফেলার সময় প্রথমে আমরা মাত্র পাঁচজন মিলে সেই গাছগুলো রক্ষার জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে সড়ক বিভাজকের গাছ রক্ষায় টানা পাঁচ মাস আন্দোলন করে সেখানকার শেষ গাছগুলো আমরা রক্ষা করতে পেরেছি। এরপর ফার্মগেটের শহীদ আনোয়ারা উদ্যান। আমরা একটি বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি যে পার্ক রক্ষা শুধু কিছু গাছ রক্ষার বিষয় নয়, এটি সামগ্রিকভাবে আমাদের জনপরিসর এবং প্রতিবেশব্যবস্থা রক্ষার বিষয়।

প্রশ্ন

কেউ কেউ বলছেন, এটি তো একটি ছোট্ট পার্ক। দেশে আরও তো অনেক পার্ক-মাঠ ধ্বংস হচ্ছে।

নাঈম উল হাসান: কাঁঠালবাগান, সেন্ট্রাল রোড ও হাতিরপুল থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত এলাকায় এটি একমাত্র সবুজ এলাকা। এসব এলাকার অধিবাসীদের দাঁড়ানোর মতো জায়গা বলতে ‘ছোট’ এই পার্ক। বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ঠিকাদার ও ভূমিদস্যুদের স্বার্থে শহরের সবুজ ধ্বংস করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। নগরবাসীর অধিকার ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল থাকলে এসব বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা, জলাভূমি এবং মাঠগুলো রক্ষা করা সম্ভব। বিগত দিনে মেগা প্রকল্প নিয়ে পরিবেশ রক্ষার নামে শুরু হয় লুটপাট। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী এই সময়ে এসে দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই।  

প্রশ্ন

আপনারা বলছেন আগের প্রকল্পগুলো কোনো সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়িত হচ্ছে।

নাঈম উল হাসান: আমরা ভেবেছিলাম ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর মেগা প্রকল্পগুলো সংশোধন ও পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা দেখলাম, তা হচ্ছে না; বরং বিগত সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো আগের নকশা ও নিয়মে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশের মাঠ-পার্কবিষয়ক আইনে বলা আছে, এর কোনো শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। আবার পরের লাইনে আবেদনের মাধ্যমে শ্রেণি পরিবর্তনের বিধান রাখা হয়েছে। দখলকারীদের জন্য শাস্তির বিধানও খুব কম। কেউ যদি ক্ষমতার জোরে পার্ক দখল করে কোটি টাকা আয় করতে পারে, তার জন্য ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়া কঠিন কিছু নয়। তাই মাঠ, পার্ক ও জলাধারবিষয়ক আইনে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। অচিরেই এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরব।

প্রশ্ন

এই আন্দোলনের সূত্রপাত হলো কীভাবে। আপনারা কীভাবে যুক্ত হলেন?

আমিরুল রাজিব: সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে শুরু করে সাতমসজিদ, আনোয়ারা উদ্যানসহ বেশ কয়েকটি আন্দোলনে আমরা সফল হয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় এই আন্দোলনও শুরু হয়। আমরা সেখানে গিয়ে দেখি একটি ট্রাকে করে কাটা গাছ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা সেখানে গিয়ে গাছ কাটা থামাই এবং তৎক্ষণাৎ অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করি, যা এখনো চলমান। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল নকশা পরিবর্তন করে হাতিরঝিলের একটি অংশে পিলার বসানোর নকশা করেছে একটি প্রতিষ্ঠান। যাঁরা ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে অনেক পরিবেশবিধ্বংসী মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনাকারী এবং নকশাকার, তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম এবং পরিবেশ আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের কাজ নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁদের কারণে পান্থকুঞ্জের দুই হাজার গাছ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। এসব বিষয় আমরা সামনে নিয়ে এলে তার মদদপুষ্ট সংগঠন পান্থকুঞ্জে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।

প্রশ্ন

ঢাকার যানজট নিরসনে এই প্রকল্প করা হচ্ছে। আপনারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে না দিলে এর বিকল্প কী?

নাঈম উল হাসান: প্রথমত, যানজট নিরসনের জন্য ২০০৫ সালের স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কথা বলা আছে ৬ নম্বরে। সেখানে আগের গণপরিবহনসংক্রান্ত সব প্রস্তাব বাদ দিয়ে সর্বশেষ এই প্রকল্প কেন গ্রহণ করা হলো, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত। যে এক্সপ্রেসওয়ের কথা বলা হয়েছে, সেটাও সার্কুলার এক্সপ্রেসওয়ে ছিল। যেখানে ঢাকা শহরের মধ্যে র‍্যাম্প নামানোর প্রস্তাব ছিল না। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের জন্য এই প্রকল্পের অধীনে কারওয়ান বাজার থেকে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক (প্রকল্পের ভাষায় র‍্যাম্প) নির্মাণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা হাতিরঝিলের মতো এই অঞ্চলে টিকে থাকা সংবেদনশীল জলাশয়ের মারাত্মক ক্ষতি করবে। হাতিরঝিলের জলপ্রবাহ সচল করার জন্য এক দশকের বিজিএমইএ ভবন সরানোর আন্দোলনের পরও এই প্রকল্পের বেশ কিছু পিলার বসানোর জন্য হাতিরঝিল আবার ভরাট করা হয়েছে। প্রকল্পের পিলারে হাতিরঝিলের পানিপ্রবাহ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ঝিলের সৌন্দর্য, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন করে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ সড়কটি নির্মিত হচ্ছে ঢাকার অন্যতম জনবহুল ও যানজটপূর্ণ এলাকায়। পান্থপথ থেকে কাঁঠালবাগান হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ওই অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। ফলে জনস্বার্থের কথা চিন্তা করলে অবশ্যই ওই প্রকল্প বন্ধ করতে হবে।  

প্রশ্ন

বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?

আমিরুল রাজিব: যেকোনো পরিবেশগত বিপর্যয়ে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হয় স্থানীয় মানুষ। কারণ, বাসস্থান মানেই শুধু কিছু ভবন বা অবকাঠামো নয়। গাছ, পাখি, পানি, নদী, বাতাস—সবকিছু মিলেই মানুষ একটি এলাকায় বাস করে। আমরা সামগ্রিকভাবে এই সব কটি উপাদানকে রক্ষা করার কথা বলছি। ফলে আলাদাভাবে শুধু গাছ রক্ষা অথবা মাঠ রক্ষার কথা অনেক পরিবেশ নামধারী সংগঠন এবং বৈদেশিক সহায়তানির্ভর সংস্থা বললেও আমরা তা বলছি না। আমরা বলছি, একটি পাখির জন্য হলেও পার্কটিকে রক্ষা করতে হবে এবং এটা সম্ভব। নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এটা করা উচিত। আমরা সে ধরনের একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের বড় সীমাবদ্ধতা হলো সংগঠন ও দাতা সংস্থানির্ভরতা এবং এসব আন্দোলনের পেছনে পরিবেশের কথা বলে নানা প্রকল্প-বাণিজ্য হতে দেখা যায়। এতে আমরা নির্দিষ্টভাবে কিছু ব্যক্তির ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল হতে দেখেছি। যে কারণে আমরা এ আন্দোলনে এসব পরিবেশ ব্যবসায়ীরও মুখোশ খুলে যেতে দেখছি। তাঁরা গণমাধ্যমে এ আন্দোলন নিয়ে নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য দেওয়া এবং বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। আমরা মনে করি, এই আন্দোলন বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় নতুন একটি ধরনকে প্রতিষ্ঠা করবে। গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব রয়েছে ব্যবসায়িকভাবে পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পরিবেশ সংরক্ষণের দাবিতে মাঠে নামলে তাঁদের প্রশ্ন করা এবং তাঁদের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান চালানো। সেটা না হলে গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠবে।

প্রশ্ন

সময় দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।

আমিরুল রাজিব ও নাঈম উল হাসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।