অন্তঃসত্ত্বা নারী
অন্তঃসত্ত্বা নারী

ডেঙ্গুতে অন্তঃসত্ত্বা নার্সের মৃত্যু

‘প্ল্যাটিলেট জোগাড়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথাটাও বলতে পারিনি’

সালমা আক্তার ও মো. আলী জিন্নাহ তাঁদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। মায়ের গর্ভে থাকা এই অনাগত সন্তানের বয়স হয়েছিল ছয় মাস। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী সালমা আক্তারের সঙ্গে এই সন্তানকেও হারিয়েছেন আলী জিন্নাহ। চার বছর বয়সী ছেলে সাজিদকে নিয়ে আলী জিন্নাহর নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

সালমা আক্তার পেশায় নার্স ছিলেন। ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর থেকে রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে স্টাফ নার্স হিসেবে কাজ করছিলেন। সর্বশেষ তিনি হাসপাতালটিতে পোস্ট আইসিইউয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ৮ অক্টোবর শ্যামলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পরদিন তাঁকে দিনাজপুরে দাফন করা হয়।

মো. আলী জিন্নাহ বর্তমানে ছেলে সাজিদকে নিয়ে দিনাজপুরেই আছেন। গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। স্ত্রীর জন্য বিভিন্ন হাসপাতালের আইসিইউ খোঁজা ও প্ল্যাটিলেট সংগ্রহ করার জন্য এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে মারা যাওয়ার আগে স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথাটাও বলতে পারিনি। আমি হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে স্ত্রী ততক্ষণে কোমায় চলে গিয়েছিল। এরপর আর ফেরেনি। শুধু চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।’

মারা যাওয়ার তিন দিন আগেও নিয়মিত চেকআপ করার জন্য চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলেন সালমা। তখন তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা বা জটিলতা ছিল না। ৫ অক্টোবর সালমা ও জিন্নাহ দুজনেরই জ্বর হয়। নাপা খেলে জিন্নাহর জ্বর সেরে যায়। তবে সালমার জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ওঠে। পরে জ্বর কিছুটা কম থাকায় ৭ অক্টোবর তিনি হাসপাতালে ডিউটিতে যান। ওই হাসপাতালেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করালে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তবে সালমার শরীর খারাপ লাগা বাড়তে থাকে।

মো. আলী জিন্নাহ গাজীপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি বলেন, স্ত্রী তাঁকে ফোন করে শরীর খারাপ লাগার কথা জানালে তিনি অফিস থেকে দ্রুত মিরপুরে স্ত্রীর হাসপাতালে চলে আসেন। হাসপাতাল থেকেই জানানো হয়, সালমার প্ল্যাটিলেট অনেক কমে গেছে।

আলী জিন্নাহ বলেন, ‘সালমার কাছেই জেনেছি, একজন মানুষের প্ল্যাটিলেট কত থাকতে হয়। সেই তুলনায় সালমার প্ল্যাটিলেট তো অনেক কমে গেছে। আমার হাত–পা কাঁপতে থাকে। সালমার হাসপাতাল থেকেই বাইরের কোনো ল্যাবে আরও কিছু পরীক্ষা করানোর কথা বলেন চিকিৎসকেরা।’

শ্যামলীসহ কয়েকটি জায়গায় ঘুরেও আলী জিন্নাহ সালমার অন্য পরীক্ষাগুলো করাতে পারেননি। কারণ, কেউ দ্রুত রিপোর্ট দিতে পারছিলেন না। তারপর কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালে পরীক্ষা করালে জানা যায়, সালমার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। প্ল্যাটিলেট কমে যাওয়াসহ ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য আবার দৌড়ানো শুরু হয়।

সালমা তাঁর নিজের হাসপাতালেই ভর্তি হতে চেয়েছিলেন, তবে যেহেতু ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তাই সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন বলে জানান আলী জিন্নাহ। তিনি বলেন, এই হাসপাতাল থেকেও বলা হয়, রোগীর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। তাঁকে আইসিইউয়ে ভর্তি করতে হবে। এখানে আইসিইউয়ে কোনো সিট খালি নেই।

বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে রাত দেড়টা থেকে দুইটা বেজে গেছে। আলী জিন্নাহ বলেন, ‘একেক হাসপাতালে গিয়ে শুধু আইসিইউর জন্য একেকজনের পা ধরতে বাকি রেখেছি। কিন্তু কোথাও পাইনি। পরে শ্যামলীতে একটি হাসপাতালের আইসিইউয়ে ভর্তি করাতে পারি। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা।’

আলী জিন্নাহ বলেন, ‘সকাল ছয়টার দিকে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। তখনই চিকিৎসক জানান, অবস্থা ভালো নয়, যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। রক্তদাতা সংগ্রহ করে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিনগরে পুলিশ হাসপাতালে যাই প্ল্যাটিলেট সংগ্রহ করতে। এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে ফোন আসতে থাকে সালমার অবস্থা ভালো নয়।’

৮ অক্টোবর বেলা ২টা ২০ মিনিটের দিকে চিকিৎসক জানান, সালমা মারা গেছেন। আলী জিন্নাহ বলেন, ‘দুপুর ১২টার দিকে সালমা ছেলেকে কাছে ডেকে আদর করেছিল। আমার সঙ্গেও কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন তো আমি হাসপাতালের বাইরে ছিলাম। যখন ফিরলাম, তখন তো আর সালমা কোনো কথাই বলতে পারল না।’

৯ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৮ অক্টোবর সকাল আটটা থেকে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে চারজনের মৃত্যু হয় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। আর চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৫৩ হাজার ১৯৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চলতি বছর সেপ্টেম্বরে দেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও সংক্রমণ হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে একাধিক জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশেষজ্ঞ ওই মাসে বলেছিলেন, অক্টোবর বা নভেম্বরে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে। চলতি মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে।

আলী জিন্নাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্ত্রীকে অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি, এতে আমি নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিই। ২০২০ সালে বিয়ে হলেও সালমার সঙ্গে ১০ বছরের পরিচয়। অনাগত সন্তানসহ দুই সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম দুজন মিলে। এখন তো সব শেষ।’

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমাদের বাসা মিরপুরে। আগে মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের মশার ওষুধ ছিটাতে দেখতাম, এখন তো তা–ও চোখে পড়ে না।’

নোট: সালমার পরিবার তাঁর ছবি প্রকাশ করতে চায় না বলে প্রতিবেদনে প্রতীকী ছবি ব্যবহার করা হলো।