
কন্টেন্ট ক্রিয়েশন ও ভাইরালের তোড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা এক প্রকার ‘অত্যাচারের শিকার’ হচ্ছেন বলে এক অনুষ্ঠানে আলোচনায় উঠে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরও সংবেদনশীল হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন অনুষ্ঠানটির বক্তারা।
আজ সোমবার রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গণমাধ্যম পুরস্কার ২০২৫ (জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা) প্রদান অনুষ্ঠানে অতিথিদের কথায় বিষয়টি আলোচনায় আসে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও জাগো ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত ‘সমতায় তারুণ্য: ইয়ুথ ফর ইকুয়ালটি’ প্রকল্পের উদ্যোগে এ পুরস্কার দেওয়া হয় ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায়।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী হেনস্তার দিকটি তুলে ধরে তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করেন।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে অত্যাচার, তাতে মূলধারার মিডিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। সরকার ব্যবস্থা নেয় না। ঐকমত্য কমিশনে নারী নেই। এটা নিয়ে অনেকবার বলার পরেও কোনো জবাব নেই। নারী কমিশনকে যেভাবে গালিগালাজ করা হয়েছে, তাতে সরকারের প্রতিবাদ দেখা যায়নি। নারীরা প্রতিবাদ করেছেন। সেটা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা হেনস্তা করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ থেকেও এসব বিষয়ে সরকারের দায়বদ্ধতার বিষয়টি সেভাবে বলা যায়নি।’
সাংবাদিকদের সংবেদনশীল হওয়ার ওপর জোর দিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের কনসাল্টিং এডিটর কামাল আহমেদ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানের কনটেন্টে সংবেদনশীলতার অভাব আছে এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়াতে দেখা যায়। এখন ভাইরালের সময় যাচ্ছে, যাচাই হচ্ছে না। কনটেন্ট ক্রিয়েশন যে পর্যায়ে গেছে, তাতে বিদ্বেষ ও ঘৃণা চাষের জায়গা তৈরি হয়েছে। নারীরা বেশি শিকার হচ্ছেন। এর বিপদগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। কোনটা সাংবাদিকতা আর কোনটা অপপ্রচার, তা বের করতে মিডিয়া লিটারেসির উদ্যোগ নিতে হবে।’
সমতার প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরও সমতা হয়নি, যা নারী সাংবাদিকেরা টের পেয়েছেন। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে পথ বলে দেওয়া আছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের কাজ সরকারের এবং সাংবাদিক সংগঠনের কাজ বাস্তবায়নের দাবি করা।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গত মে মাসে জমা দেওয়ার পরও তার কোনো কিছুর বাস্তবায়ন না দেখে হতাশা প্রকাশ করেন এই কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে পাঁচ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে জাতীয় দৈনিক ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন দৈনিক সমকালের মো. শাহেরীন আরাফাত; রানারআপ হয়েছেন ডেইলি সানের রফিকুল ইসলাম; দৈনিক কালবেলার জাফর ইকবাল; প্রথম আলোর নাজনীন আখতার ও মানসুরা হোসাইন।
টিভি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এখন টিভির প্রতিবেদক তাসলিমা মেহেরিন এ্যানি এবং রানারআপ হয়েছেন চ্যানেল ২৪–এর জিনিয়া কবীর সূচনা।
অনলাইন রিপোর্ট ক্যাটাগরিতে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক জুবায়ের আহমেদ চ্যাম্পিয়ন এবং জাগোনিউজ২৪.কমের আল-আমিন হাসান আদিব ও ইয়াসির আরাফাত রিপন এবং ঢাকা পোস্টের আরাফাত জোবায়ের রানারআপ হয়েছেন।
স্থানীয় সংবাদপত্র ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন দৈনিক জন্মভূমির বিশেষ প্রতিবেদক আওয়াল শেখ এবং রানারআপ হয়েছেন একুশে পত্রিকার শরীফুল রুকন।
বিজ্ঞাপন (টিভি) ক্যাটাগরিতে ট্রিম পিকচারের পরিচালক শাহেদ শাহরুখ চ্যাম্পিয়ন এবং যন্ত্রাক্ষী ফিল্মসের হাসান রেজাউল রানারআপ হয়েছেন।
এই পুরস্কারে জুরিবোর্ডের প্রধান ছিলেন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের (নিমকো) পরিচালক পারভীন সুলতানা রাব্বী এবং সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজীদা আখতার, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের চেয়ারম্যান শেখ শফিউল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এবং সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন সজীব সরকার।
অনুষ্ঠানে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য হালিদা হানুম আখতার বলেন, গণমাধ্যমের চ্যাম্পিয়ন মানে সবাই চ্যাম্পিয়ন। কারণ, সাংবাদিকেরা যা তুলে ধরেন, তার প্রভাব বেশি। নারী হারিয়ে যায় কেন, তা সামনে আনতে হবে। নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে হবে। যেসব প্রশিক্ষণ হচ্ছে, সেগুলো জেন্ডার সংবেদনশীল কি না, তা বিবেচনা করতে হবে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন বলেন, সংবেদনশীল মন থাকা সবচেয়ে জরুরি। প্রতিবেদকেরা তথ্য বের করে আনেন এবং কাজ করেন। কিন্তু সেই সংবাদ যাঁরা সম্পাদনা করেন, তাঁদেরও সংবেদনশীল মনোভাব থাকতে হবে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানকেও সংবেদনশীল হতে হবে।
অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্যে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কে তুলে ধরে বলেন, কিশোর–যুবারা কীভাবে নেতৃত্ব দেবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় আসবে এবং সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠায় নিজেদের যুক্ত করতে পারে, সে কাজ বিশ্বজুড়ে করছে প্ল্যান। সমাজের ধরাবাঁধা কুসংস্কার দূর করার জন্য কিশোর–কিশোরীরা যেন কাজ করতে পারে, তেমন অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার কাজ করছেন তাঁরা।
এই পুরস্কার দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের বার্তা সবার কাছে যায়। তাই তাঁদের সম্মানিত করার জন্য তাঁদের এই প্রচেষ্টা।
মৌসুমী মৌয়ের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জাগো ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ইফতিখার উল করিম,প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান মনিরা শরমিন এবং জুরিবোর্ডের সদস্য পারভীন সুলতানা রাব্বী, শেখ শফিউল ইসলাম ও রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য দেন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন) নিশাত সুলতানা। অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান আলোক ও জাহান।