প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা–অগ্নিসংযোগসহ দেশজুড়ে সংঘটিত সহিংসতার কথা তুলে ধরে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং বিচারহীনতার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। সরকারকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে।
শনিবার এক বিবৃতিতে অধিকার এসব কথা বলেছে। এতে সরকারের কাছে ছয়টি সুপারিশও তুলে ধরেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, শরিফ ওসমান বিন হাদিকে ১২ ডিসেম্বর গুলি করে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। এরপর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলে ১৮ ডিসেম্বর তিনি সেখানে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওসমান হাদি ছিলেন চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের একজন সংগঠক এবং পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক। তিনি বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করতেন এবং আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীও ছিলেন।
অধিকার বলেছে, ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ১৮ ডিসেম্বর রাতে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ে, সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট কার্যালয়ে এবং ১৯ ডিসেম্বর আরেকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে এবং সম্পদ ধ্বংস করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ১৮ ডিসেম্বর রাতে ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে ৩০–৩৫ জন সাংবাদিক আটকা পড়েন। তাঁদের সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধার করেন। এদিন হামলাকারীদের হেনস্তার শিকার হয়েছেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরও।
বিবৃতিতে বলা হয়, ১৮ ডিসেম্বর রাতেই ময়মনসিংহের ভালুকায় ‘ধর্ম নিয়ে কটূক্তি’ করার অভিযোগে পাইওনিয়ার নিট কম্পোজিট কারখানার শ্রমিক দীপুচন্দ্র দাসকে (২৫) মারধর করে গাছে ঝুলিয়ে পিটিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয় ‘তৌহিদী জনতা’ নামের গোষ্ঠী। এ ছাড়া ১৯ ডিসেম্বর রাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং শেখ হাসিনার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহার মাগুরা জেলার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
অধিকার বলেছে, ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলে তিনটি জাতীয় নির্বাচন এবং সব কটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক। হাসিনার আমলে জাতীয় নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ ছিল লক্ষণীয়। আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই ওসমান হাদিকে গুলি করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত কর্মী ভারতে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ওসমান হাদির মৃত্যুর সংবাদের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁকে গুলি করে হত্যা, পত্রিকা অফিসে হামলা, সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর হামলা, দীপুচন্দ্র দাসকে হত্যা, ছায়ানট ও উদীচীতে হামলা, প্রসিকিউটরের বাসভবনে হামলার চরম নিন্দা জানাচ্ছে অধিকার।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনটি মনে করে, বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য কিছু গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন সহিংস হবে, তা আগেই হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ভয়াবহ সংঘাত ও নাশকতার আগে গোয়েন্দা নজরদারি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপের অভাব নাগরিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
অধিকার মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব—দেশের জনগণের জানমাল রক্ষা করা এবং সুষ্ঠুভাবে আসন্ন নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। আর এই হত্যা, নাশকতা, হুমকি আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল করারই প্রচেষ্টা।
এ বিষয়ে সরকারের কাছে ছয়টি সুপারিশ তুলে ধরেছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনটি। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করা ও ভারতে পালিয়ে যাওয়া অভিযুক্ত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে ভারত সরকারের ওপর প্রয়োজনে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ; দীপুচন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা; সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম, ভিন্নমতাবলম্বীসহ সব নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে আসন্ন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বতাকারী সব প্রার্থী এবং হুমকি পাওয়া জুলাই আন্দোলনের সব নেতা–কর্মীর নিরাপত্তা প্রদান; গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো, যাতে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটার আগেই তা প্রতিহত করা যায় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা ও সন্ত্রাসের নামে যাতে কোনো হত্যা–নাশকতা না ঘটে, সে বিষয়ে সরকারকে অত্যন্ত তৎপর হওয়া।