জীবনসঙ্গী বা স্বামী এবং প্রেমিক বা অন্য পুরুষের হাতে অন্তত একবার নির্যাতনের শিকার ৭০% নারী।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার এক তরুণী যৌতুকের টাকার জন্য স্বামীর হাতে প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হতেন। স্বামী একবার তলপেটে এমন জোরে লাথি দিয়েছিলেন যে তাঁকে দুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
ঘটনাটি ২০২৩ সালের। ওই তরুণী মায়ের কাছ থেকে শুনেছেন, তাঁর চিকিৎসা করাতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, নির্যাতনের কারণে দুই বছরের বেশি সংসার করতে পারেননি তিনি।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম আলো কার্যালয়ে সন্তানসহ এক নারী এসে যোগাযোগ করেছিলেন স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে। যশোরের ওই নারী জানান, তিনি স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। এখন স্বামী তাঁকে সংসারে রাখতে চান না, মারধর করেন। স্বামীর বিরুদ্ধে গত বছর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ১১(গ) (যৌতুকের) ধারায় মামলা করেন তিনি। মামলা চালাতে তাঁর ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবনসঙ্গী বা স্বামী এবং প্রেমিক বা অন্য পুরুষের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের নিজ খরচে চিকিৎসা ও আইনি পদক্ষেপ নেওয়া বাবদ ব্যয়ের বোঝা টানতে হয়।
জরিপ প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ গত মার্চে প্রকাশ করে বিবিএস। জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে যাঁরা গত ১২ মাসে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর চিকিৎসা ও আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাঁদের জনপ্রতি গড়ে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫১২ টাকা। আইনি লড়াইয়ে ব্যয় হয়েছে গড়ে ৪ হাজার ১০৪ টাকা। গ্রামে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার কাজে খরচ হয়েছে যথাক্রমে ২ হাজার ৬৭২ ও ৩ হাজার ৬৮০ টাকা। শহরে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩৯৪ ও ৪ হাজার ৩৪১ টাকা।
এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ করা হলো। এর আগে ২০১১ ও ২০১৫ সালে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়, জীবনসঙ্গী বা স্বামীর হাতে সহিংসতা বাংলাদেশে এতটাই প্রকট যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী (২০১৫ সালে ৭৩ শতাংশ, ২০১১ সালে ৮০ শতাংশ) তাঁদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। ৪১ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে গত ১২ মাসে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন সহিংসতামূলক আচরণগুলো অন্তর্ভুক্ত করলে এই সহিংসতার ব্যাপকতা আরও বেশি—জীবনে অন্তত একবার ৭৬ শতাংশ নারী এবং গত ১২ মাসে ৪৯ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ১৫ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রেমিক বা অন্য পুরুষের মাধ্যমে। এই খানাভিত্তিক জরিপে শহর, গ্রাম, দুর্যোগপ্রবণ এবং বস্তি এলাকার ১৫ বছর ও এর থেকে বেশি বয়সী ২৭ হাজার ৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
বিবিএসের ‘ইন্টিগ্রেটিং জিওস্পেশাল ইনফরমেশন উইথ জেন্ডার অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রজেক্ট’–এর প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার ধরন ও মাত্রা বুঝতে এই জরিপ করা হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার সিরাজগঞ্জের ওই তরুণী বলেন, এত নির্যাতনের পরও তিনি কোনো মামলা করেননি। মামলার পেছনে দৌড়ানো একটা ‘ঝামেলা’। ‘মানসম্মান হারানোরও’ ভয় আছে। দেনমোহর ছিল দুই লাখ টাকা। সেই টাকা উদ্ধারেও ব্যবস্থা নেননি।
ঢাকার আরেক তরুণী (২৫) প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমিক তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরিবারের লোকজনের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের কথা বললে প্রেমিক নানা অজুহাতে তা পেছাতে থাকেন। এর মধ্যে একদিন তিনি জানতে পারেন, প্রেমিক গোপনে বিয়ে করে ফেলেছেন। ঘটনা শুনে গত বছরের শুরুর দিকে ওই বাড়িতে গেলে প্রেমিক ও তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
বিবিএস ও ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ নির্যাতনের বিষয়ে নীরব থাকেন। পরিবারের সুনাম রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ এবং এ ধরনের সহিংসতা স্বাভাবিক বলে মনে করার প্রবণতার কারণে নীরব থাকেন তাঁরা। মাত্র ৭ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নেন। ভুক্তভোগীদের ৫১ শতাংশই জানেন না, কোথায় গিয়ে অভিযোগ করতে হবে।
কেউ কেউ আইনি পথে গেলেও বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলা নিয়ে প্রথম আলো প্রায় দেড় বছরের অনুসন্ধান করে এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছিল (২০১৮), ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছেন, নয়তো পরে খালাস পেয়েছেন।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনের শিকার কোনো কোনো নারীকে একাধিকবার চিকিৎসা নিতে হয়, আইনি সহায়তা নিতে বারবার সালিস বা আদালতে যেতে হয়। এর ব্যয় কম নয়। তিনি বলেন, নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। নির্যাতনমূলক সম্পর্ক থেকে মেয়েটিকেও বেরিয়ে আসতে হবে। নির্যাতন প্রতিরোধে তিনি ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেওয়া ও সেই অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর জোর দেন।