দেশে দিনে গড়ে ৪০টি আত্মহত্যা, সবচেয়ে বেশি যশোরে

দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এর মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি।

গতকাল সোমবার রাজধানীতে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ক্রাইম) মো. আশরাফুল ইসলাম এ তথ্যের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দেশের জেলাগুলোর মধ্যে যশোরে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা (খসড়া) নিয়ে আলোচনার জন্য ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর আয়োজক যৌথভাবে আইসিডিডিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা একক কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য, কৃষি, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, ধর্ম, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ যৌথ ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান, পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

আত্মহত্যার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যই সাধারণত জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা ব্যবহার করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য (২০২১ সাল) বলছে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৪ হাজার ৭১৪টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। অন্যদিকে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ওই বছর পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ আত্মহত্যার ঘটনা ১৫ হাজার ৫০টি। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া অনুমিত সংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রকৃত সংখ্যা তিন গুণ বেশি।

অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, আত্মহত্যার কথা হলেও প্রতিরোধে দেশে কাজ কম হচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা একক কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য, কৃষি, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, ধর্ম, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ যৌথ ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া অনুমিত সংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রকৃত সংখ্যা তিন গুণ বেশি।

দৈনিক গড়ে ৪০টি আত্মহত্যা

আত্মহত্যা

আত্মহত্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপনার সময় আইসিডিডিআরবির মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের সহকারী সমন্বয়ক মোহাম্মদ সোহেল শমীক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৭১৪টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রতি লাখ মানুষে আত্মহত্যার ঘটনা ২ দশমিক ৮টি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন বলছে, ওই বছর দেশে আত্মহত্যা ছিল প্রতি লাখে ৮ দশমিক ৬৮টি। অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত সংখ্যার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া সংখ্যা বড়।

পুলিশও বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমিত সংখ্যার চেয়ে দেশে আত্মহত্যার প্রকৃত সংখ্যা বেশি। আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর বিবরণ থাকে পুলিশের খাতায়। পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারা দেশের ‘আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর’ তথ্য উপস্থাপন করেন।

উপস্থাপনায় দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত—এই পাঁচ বছরে দেশে মোট ৭৩ হাজার ৫৯৭ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১৪ হাজার ৭১৯ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। সেই হিসাবে দৈনিক ৪০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১২ হাজার ৩৩৫টি ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় একই (সামান্য বেশি, ৪১টি)।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১২ হাজার ৩৩৫টি ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় একই (সামান্য বেশি, ৪১টি)।

ফাঁসের ঘটনা বেশি

পুলিশের বিবরণীতে ফাঁস, বিষপান, গায়ে আগুন, রেললাইনে ঝাঁপ ও অন্যান্য—এই পাঁচভাবে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। এরপর ব্যবহৃত পদ্ধতি বিষপান।

মামলার হিসাবে দেখা যায়, ৬৪ জেলার মধ্যে আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা সবচেয়ে বেশি যশোর জেলায়। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই জেলায় এ–সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৪টি। এরপর বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা জেলায়, ১ হাজার ৪০২টি। তৃতীয় স্থানে আছে কুমিল্লা। এ জেলায় একই সময় মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৮৮টি।

ভয় কৃষির বিষে

অনুষ্ঠানে আত্মহত্যায় কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার নিয়ে কথা ওঠে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রটেকশন ইউনিটের উপপরিচালক কাজী শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে ৩৪২ ধরনের কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘাসনাশক। দুটি ঘাসনাশক আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না; লাইসেন্স নবায়নও করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, বেশি ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া কীটনাশক বা আগাছানাশকের প্যাকেট বা বোতলের গায়ে সতর্কতামূলক বার্তা বা তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ আছে সরকারের।

সম্মান রক্ষা ও শাস্তির ভয়ে মানুষ আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো চেপে যান। তাই এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন।

কাজী শফিকুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে বেশি কীটনাশকের ব্যবহার হতে দেখা যায় বেগুনের ক্ষেত্রে। আবার ধনেপাতায় কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন না হলেও অনেক কৃষক এতে কীটনাশক ব্যবহার করেন।

কীটনাশক বা আগাছানাশকের ব্যবহার কমলে আত্মহত্যা কমে আসার সম্ভাবনা আছে বলে একাধিক আলোচক মন্তব্য করেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কান পেতে রই–এর পরিচালক (স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পার্টনারশিপ) রুনিহা জাহান বলেন, ভারতের কিছু এলাকায় কৃষকদের মধ্যে কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার কমানোর জন্য কমিউনিটি উদ্যোগ আছে। ওই সব এলাকায় কৃষক বাড়িতে কীটনাশক বা আগাছানাশক নিতে পারবেন না। কৃষকের প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁর জমিতে কমিউনিটির পক্ষ থেকে কীটনাশক বা আগাছানাশক প্রয়োগ করা হয়। এটা করা হয়েছে, যেন কেউ সহজে হাতের কাছে কীটনাশক বা আগাছানাশক না পান।

কীটনাশক বা আগাছানাশকের ব্যবহার কমলে আত্মহত্যা কমে আসার সম্ভাবনা আছে বলে একাধিক আলোচক মন্তব্য করেন।

অপরাধ নয়, মানসিক সমস্যা

অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, আত্মহত্যার কারণ মূলত মানসিক বিপর্যয়। কিছু মানসিক রোগ আত্মহত্যার পেছনে কাজ করে। কিন্তু আত্মহত্যাকে আইনে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়েছে। এই অপরাধে সাজাও আছে। যিনি আত্মহত্যা করেন, তাঁর সাজা ভোগ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যিনি আত্মহত্যা করে ব্যর্থ হন, আইনের চোখে তিনি অপরাধী, তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। সম্মান রক্ষা ও শাস্তির ভয়ে মানুষ আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো চেপে যান। তাই এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন।