Thank you for trying Sticky AMP!!

তালাক বেড়েছে, বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক

২০২২ সালে বেড়েছে বিয়ে ও তালাক।এর সঙ্গে করোনাকালের সম্পর্ক দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। 

দেশে বিয়ের হার বেড়েছে। বেড়েছে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদও। আর বিবাহবিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা (বনিবনার অভাব)।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নতুন এক জরিপ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটির নাম বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস–২০২২। জরিপ প্রতিবেদনটি গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। জরিপটিতে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে তিন লাখের বেশি খানা (পরিবার)।

জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশকারী বিবিএসের এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসভিআরএস জরিপের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের কারণের তথ্য আমরা অতীতেও সংগ্রহ করতাম, তবে প্রকাশ করা হতো না। এবারের জরিপেই প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হলো।’

মহামারির সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে বিয়ে উৎসাহিত হয়নি। ২০২২ সালে সংকটটি অনেকটা কেটে যাওয়ায় বিয়ে বেড়েছে।
মাহবুবা নাসরীন, সমাজবিজ্ঞানী

বিয়ে বেড়েছে

২০২২ সালে সাধারণ বিয়ের হার পাওয়া গেছে ২৫–এর কিছু বেশি। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ওই বছর যত জনের বিয়ে হয়েছে, সেটা সাধারণ বিয়ের হার। এই হার ২০২১ সালে ছিল ১৮.৫।

জরিপ প্রতিবেদনে ২০০৬ সাল থেকে সাধারণ বিয়ের হারের গতিধারাও তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ বিয়ের হার এক বছরের ব্যবধানে অনেকটা বেড়েছে। এর আগের বছরগুলোতে তা ১৭ থেকে ২১–এর মধ্যে ছিল।

২০২২ সালে সাধারণ বিয়ের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনাকালের অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার সম্পর্ক দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, ২০২০ ও ২১ সালের ধাক্কা অনেকটা কাটিয়ে ওঠার পর ২০২২ সালে বিয়ের হার বেড়েছে। গ্রামে এ হার বেশি।

Also Read: যেসব বিচ্ছেদ বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল

সাধারণ বিয়ের হারে নারী-পুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। তবে ধর্মভেদে তারতম্য দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে হারটি বেশি—২৬। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তা ১৮–এর কিছু বেশি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রে সাধারণ বিয়ের হার ১৫–এর মতো।

জরিপে নারী ও পুরুষেরা প্রথম বিয়ে কত বছর বয়সে করেছেন, তার একটি গড় হিসাব উঠে এসেছে। বিবিএস বলছে, পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ছিল ২৪ বছর। নারীর ক্ষেত্রে তা ১৮ দশমিক ৪ বছর। শহরে পুরুষ ও নারীদের প্রথম বিয়ের গড় বয়স একটু বেশি। গ্রামে কম।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে, কম ময়মনসিংহ বিভাগে। দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতায় বিবাহবিচ্ছেদ বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। ভরণপোষণ দিতে অসমর্থতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি রাজশাহীতে, কম চট্টগ্রামে।

তালাকও বেড়েছে

তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের দুই ধরনের হার বিবিএসের জরিপে পাওয়া পায়। একটি হলো স্থূল, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিবাহবিচ্ছেদের হার। অন্যটি সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার, যেখানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হিসাব করা হয়।

বিবিএস বলছে, তারা বিচ্ছেদ হওয়া মানুষের নিবিড় সাক্ষাৎকার নিয়ে জরিপ করেছে। ফলে এই জরিপের মাধ্যমেই বিচ্ছেদের আসল কারণ উঠে এসেছে।

Also Read: বিচ্ছেদ কি শেষ সমাধান

বিবিএসের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূলবিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১–এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪–এ দাঁড়ায়।

সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হারটি হিসাব করা হয়েছে নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে। দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল ২–এর সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩ দশমিক ৬–এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২–এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩ দশমিক ৮–এ দাঁড়ায়।

জরিপে নারী ও পুরুষেরা প্রথম বিয়ে কত বছর বয়সে করেছেন, তার একটি গড় হিসাব উঠে এসেছে। বিবিএস বলছে, পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ছিল ২৪ বছর। নারীর ক্ষেত্রে তা ১৮ দশমিক ৪ বছর। শহরে পুরুষ ও নারীদের প্রথম বিয়ের গড় বয়স একটু বেশি। গ্রামে কম।

তালাকের যেসব কারণ

বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩ শতাংশ এই কারণ সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা—২২ শতাংশ।

ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদিও রয়েছে বিবাহবিচ্ছেদের কারণের তালিকায়।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে, কম ময়মনসিংহ বিভাগে। দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতায় বিবাহবিচ্ছেদ বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। ভরণপোষণ দিতে অসমর্থতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি রাজশাহীতে, কম চট্টগ্রামে।

Also Read: বেড়েছে বিয়ে, বেড়েছে বিচ্ছেদ

পারিবারিক চাপে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি ময়মনসিংহে, কম ঢাকায়। নির্যাতনের কারণেও বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হয়েছে ময়মনসিংহে, কম রাজশাহীতে। যৌন অক্ষমতা অথবা অনীহার কারণে রংপুরে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হয়েছে। বরিশালে এ ক্ষেত্রে হার শূন্য। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে সিলেটে।

আইনত হিন্দু সম্প্রদায়ে বিবাহবিচ্ছেদের সুযোগ নেই। তবু অনেকে ‘আলাদা’ হচ্ছেন। হিন্দু নারীদের মধ্যে মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য না করার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলমানদের মধ্যে তালাকের ঘটনার কারণগুলো জাতীয় হারের মতোই। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আলাদা’ হওয়ার কারণের দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আলাদা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ দাম্পত্যজীবন বজায় রাখতে অক্ষমতা ও শারীরিক নির্যাতন।

যেমন শারীরিক নির্যাতনকে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মুসলমানদের ১০ শতাংশের কম। হিন্দুদের ক্ষেত্রে হারটি ২০ শতাংশের কাছাকাছি।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথও মনে করেন, হিন্দু নারীদের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার হার বেশি। এর সঙ্গে যৌতুকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। হিন্দু নারীরা যেহেতু বাবার সম্পত্তির ভাগ পান না, সেহেতু তাঁদের ওপর যৌতুক আনার চাপ থাকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনত হিন্দু সম্প্রদায়ে বিবাহবিচ্ছেদের সুযোগ নেই। তবু অনেকে ‘আলাদা’ হচ্ছেন। হিন্দু নারীদের মধ্যে মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য না করার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।

অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হন না। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সেটা মেনে নিয়ে সংসার করে যান। অবশ্য অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
সমাজবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মাহবুবা নাসরীন

মহামারির যোগ

বিবিএসের পরিসংখ্যানের বাইরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন সাধারণত বেশি করেন নারীরা। ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার ৩৮৩টি, যা মোট আবেদনের ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরের চিত্রও প্রায় একই। সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের ৬৫ শতাংশ নারীর।

সমাজবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মাহবুবা নাসরীন প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হন না। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সেটা মেনে নিয়ে সংসার করে যান। অবশ্য অনেকেই দাম্পত্যজীবনে সুখী হওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

২০২২ সালে কেন হঠাৎ বিয়ে বাড়ল, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছিল মাহবুবা নাসরীনের কাছে। তিনি বলেন, তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন এর সঙ্গে করোনা মহামারির সংযোগ আছে। মহামারির সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে বিয়ে উৎসাহিত হয়নি। ২০২২ সালে সংকটটি অনেকটা কেটে যাওয়ায় বিয়ে বেড়েছে।

নানা আর্থসামাজিক কারণে বাল্যবিবাহও বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন। বিবিএসের জরিপেও সেটি পাওয়া যায়। জরিপ বলছে, ১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়া নারীর অনুপাত (২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী) ২০২২ সালে পাওয়া যায় প্রায় ৪১ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ৩২ শতাংশের আশপাশে।