
বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুনিবন্ধন কম হয়। মৃত্যুনিবন্ধনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে। মৃত নারীদের নিবন্ধন মৃত পুরুষের তুলনায় কম। শুধু সচেতনতার ঘাটতি নয়, নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম হওয়ার পেছনে বৈষম্যও আছে।
আজ শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বিষয়ে একটি গবেষণা ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা এ কথা বলেন। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বিষয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাটা ফর হেলথ ইনিশিয়েটিভ। অনুষ্ঠানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও কর্মকর্তারা অংশ নেন।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪-এর উদ্ধৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানে বলা হয়, মৃত ব্যক্তির তথ্য (নাম, বয়স, মৃত্যুস্থান, তারিখ) মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আইনটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব বলছে, পুরুষের মৃত্যুনিবন্ধন হচ্ছে ২৬ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ।
স্বাগত বক্তব্যে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ও পরিচালক লরা রিচেনবেচ বলেন, নারীর মৃত্যুনিবন্ধন শুধু পরিসংখ্যানগত কোনো বিষয় নয়, এটি অধিকারের বিষয়। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম, এর অর্থ তাঁদের অধিকার অবনমিত। তিনি আরও বলেন, আর্থসামাজিক কিছু কারণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল ও সামগ্রীর ঘাটতির কারণে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম হয়।
অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) জাহিদ হোসেন বলেন, পুরুষ ও নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে স্পষ্ট ও স্থায়ী অসমতা দৃশ্যমান। বিষয়টি এখন সরকারি নীতিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেউ যেন নিবন্ধনের বাইরে না থাকেন, সে জন্য নাগরিক সমাজ, এনজিও ও সরকারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
নারীর মৃত্যুনিবন্ধন শুধু পরিসংখ্যানগত কোনো বিষয় নয়, এটি অধিকারের বিষয়। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম, এর অর্থ তাঁদের অধিকার অবনমিতলরা রিচেনবেচ, ডিন, ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ
অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব মামুনুর রশিদ বলেন, পরিসংখ্যানে স্পষ্ট দেখা যায়, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে ঘাটতি আছে। ২০২৩-২৪ সালে রংপুরে ২০ হাজার ২০২ জন নারীর মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫৩৭ মৃত্যু বা ৩২ শতাংশ মৃত্যুর নিবন্ধন হয়েছিল। নিবন্ধন কম হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে খুব কম নারী জমি বা অন্য সম্পত্তির মালিক। সুতরাং পরিবারের সদস্যরা তাঁদের মৃত্যুনিবন্ধনে কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না।
গবেষকেরা কী দেখেছেন
গবেষকেরা রংপুর বিভাগের দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলায় চারটি উপজেলায় এই গবেষণা করেন। তাঁরা সরকারি দপ্তরের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি মানুষের মতামত, বিশ্লেষণ জানার জন্য নিবন্ধনসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, ৩৬ জন কমিউনিটি লিডার, মৃত্যুর খবর দেওয়া ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন এবং ১২টি দলগত আলোচনা করেন। গবেষণাটি হয়েছে ২০২৩-২৪ সালে।
গবেষকেরা বলছেন, নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে অন্তত পাঁচটি বাধা আছে। নিবন্ধন বিষয়ে মানুষের ধারণা বা সচেতনতা কম। নারীর জমি ও সম্পদ না থাকায় তাঁর মৃত্যুনিবন্ধনের প্রয়োজন বোধ করেন না পরিবারের সদস্যরা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে বা বিলম্বে নিবন্ধন করা হয়, যখন আইনি জটিলতা বা আর্থিক প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে অনেক সময় নিবন্ধন হয় না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে। সরকারি দপ্তরগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধন হয় না।
নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে অন্তত পাঁচটি বাধা
নিবন্ধন বিষয়ে মানুষের ধারণা বা সচেতনতা কম।
নারীর জমি ও সম্পদ না থাকায় তাঁর মৃত্যুনিবন্ধনের প্রয়োজন বোধ করেন না পরিবারের সদস্যরা।
বিলম্বে নিবন্ধন করা হয়, যখন আইনি জটিলতা বা আর্থিক প্রয়োজন পড়ে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে।
সরকারি দপ্তরগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা।
কোন কোন বিষয় নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে ভূমিকা রাখছে, তারও কিছু উদাহরণ দিয়েছেন গবেষকেরা। বাস্তব প্রয়োজন অর্থাৎ সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা ঋণ পরিশোধের বিষয় থাকলে দ্রুত নিবন্ধন হয়। নিবন্ধন অফিস বাড়ির কাছাকাছি হলে বা নিবন্ধন কার্যালয়ের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সম্পর্ক ভালো থাকলে মৃত্যুনিবন্ধন হয়। কোনো এলাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশেষ কর্মসূচি হলে নিবন্ধন বেড়ে যায়। আগে জন্মনিবন্ধন এবং সমাজকল্যাণ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা আছে—এমন পরিবারের নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বেশি হতে দেখা যায়।
সুপারিশে গবেষকেরা বলেছেন, জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে ব্যয় দূর করতে হবে, নিবন্ধন অফিসগুলোতে কর্মরত জনবলের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
মৃত্যুনিবন্ধনকে অধিকার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলেন বিশেষজ্ঞ আলোচকেরা। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদেরও ভূমিকা আছে বলে মন্তব্য করেন অবসটিট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে কোনো নারীর মৃত্যুর সময় সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি থাকেন একজন চিকিৎসক। সুতরাং মৃত্যুনিবন্ধন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরও ভূমিকা থাকা দরকার। মৃত্যুনিবন্ধন করার ব্যাপারে পরিবারগুলোকে তথ্য ও নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা আছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাওসার আফসানা।