১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট মধ্যরাতের পর পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট মধ্যরাতের পর পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ

বিজয়ের পথ—৯

ব্যাপক এক নৌ হামলা অপারেশন জ্যাকপট

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।

এক ব্যান্ডের রেডিও ঘিরে প্রতীক্ষা করছিলেন শতাধিক সাহসী যুবক। কখন বেজে উঠবে সেই গান, আসবে সেই সংকেত। সবাই এক জায়গায় নয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নৌবন্দরে তাঁদের সতর্ক অবস্থান। প্রতিটি দলের কাছেই আছে রেডিও। সেই রেডিওতে আসবে অভিযান শুরুর সংকেত।

একদিকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার প্রতীক্ষা, অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। সামান্য গড়বড় হলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট সকালে আকাশবাণী কলকাতার গানের অনুষ্ঠানে বেজে উঠল ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান, তার বদলে চাই নে কোনো দান।’ এই গানই সংকেত। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এরপর ১৫ আগস্ট আরেকটি গান বাজলেই পাওয়া যাবে অভিযানে নামার চূড়ান্ত সংকেত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে খ্যাত।

১৫ আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলো সেই গান, যার অপেক্ষায় ছিল পুরো কমান্ডো দল। গানটি হলো, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি।’ নৌ কমান্ডোরা অভিযানে নামতে শুরু করলেন। চারটি বন্দরে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন। মধ্যরাতের পর নৌ কমান্ডোরা গামছা দিয়ে বুকে মাইন বেঁধে নেমে গেলেন পানিতে। পায়ে ফিনস, কোমরে ছুরি। মাঝপথে শত্রুর মুখে পড়লে আত্মরক্ষার জন্য ছিল শুধু ওই ছুরি, কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়। তবে গেরিলা যোদ্ধাদের সমর্থনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন।

সেই অভিযানে কমান্ডোরা প্রায় একই সময়ে চারটি বন্দরে ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দেন। যুদ্ধের ইতিহাসে এটা অনন্য নজির।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাঞ্চলকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, তার মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডো। মূলত সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী ও সমুদ্রবন্দরসহ বাংলাদেশের সমগ্র জলপথ নিয়ে সেক্টরটি গঠিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ছিল নৌ কমান্ডো আক্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য।

অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রচারণা ভন্ডুল করে দেওয়া। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বহির্বিশ্বে প্রচারণা চালাচ্ছিল পাকিস্তান সরকার। কিন্তু নৌ কমান্ডোদের সফল অভিযানের মাধ্যমে তা মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয় এই নৌ অভিযানের খবর। মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। ১৫ আগস্ট রাত ১২টার পর শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপট।

১৫ আগস্ট রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দর কেঁপে ওঠে। বন্দরে এমভি হরমুজ এবং এমভি আল-আব্বাস নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজে ৯ হাজার ৯১০ টন এবং এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।

অন্যদিকে সাবমেরিনার আহসানউল্লাহর নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ কমান্ডো মোংলা বন্দরে অভিযান চালান। বন্দরের ছয়টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।

চাঁদপুর নৌবন্দর অভিযানে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন নৌ কমান্ডো সফল হন। তাঁরা ১৫ আগস্ট রাতে একই সময় চাঁদপুর বন্দরে মাইন দিয়ে কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সেই সঙ্গে সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জনের কমান্ডো দল নারায়ণগঞ্জ এবং শাহজাহান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ৯ জন কমান্ডো দাউদকান্দি নদীবন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।

পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তারা দলত্যাগ শুরু করেন। সেই বাস্তবতায় ভারতীয় নৌবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন পরিচালক মিহির কুমার রায় নৌ কমান্ডো গঠনের পরিকল্পনা করেন। সেটা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের কথা। ফ্রান্সের তুঁল নৌবন্দর থেকে পালিয়ে আসা আটজন বাঙালি নৌসেনাকে নিউক্লিয়াস ধরে তিনি মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডো দল গঠনের চিন্তা করেন।

আট বাঙালি নৌসেনা হলেন খুলনার সন্তান চিফ পেটি অফিসার গাজী মো. রহমত উল্লাহ, ফরিদপুরের পেটি অফিসার সৈয়দ মো. মোশাররফ হোসেন, কুমিল্লার পেটি অফিসার আমানউল্লাহ শেখ, রংপুরের নাবিক বদিউল আলম, চট্টগ্রামের রেডিও অপারেটর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, নোয়াখালীর মেকানিক মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ, টাঙ্গাইলের ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক শহীদ আবদুর রকিব মিয়া ও ঢাকার নাবিক আবেদুর রহমান। ফ্রান্সে পাকিস্তানের কেনা সাবমেরিনে তাঁরা প্রশিক্ষণে ছিলেন। মার্চে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর খবর পেয়ে তাঁরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তবে সেটা সহজ ছিল না। তুঁল থেকে স্পেন, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অংশগ্রহণ যেকোনো রোমাঞ্চ কাহিনিকেও হার মানায়।

নৌ কমান্ডো বাহিনীর অন্যতম সদস্য মো. খলিলুল রহমান নৌ কমান্ডো গঠনের স্মৃতিচারণা করেছেন। নিজের মুক্তিযুদ্ধে নৌ–অভিযান বইয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আটজন অসমসাহসী নাবিকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ এক বিশিষ্ট ঘটনা। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ফ্রান্স থেকে ভারত পর্যন্ত যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা শুনে সত্যই শিহরিত হতে হয়।’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পলাশীতে প্রশিক্ষণরত নৌ কমান্ডো

ভারতের নৌবাহিনীর কর্মকর্তা প্রয়াত ক্যাপ্টেন এম এন আর সামন্ত এবং সাংবাদিক সন্দীপ উন্নিথান অপারেশন এক্স বইয়ে নৌ কমান্ডো গঠনের পরিকল্পনার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁরা লিখেছেন, এপ্রিল মাসে মিহির কুমার রায় হাতে লিখে এই পরিকল্পনা করেন। ছয় পৃষ্ঠার সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে গঠিত হয় নৌ কমান্ডো। চূড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৩ মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ভাগীরথী নদীর তীরে ঐতিহাসিক পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এর সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘সি-টু-পি’। জুন মাসের প্রথম দিকে বিভিন্ন সেক্টর থেকে বাছাই করা ৩০০ জনের ভালো সাঁতারুর একটি দল সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে।

খলিলুর রহমান লিখেছেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চল, বন-জঙ্গলে পূর্ণ এই স্থানে সামরিক অথবা বেসামরিক পদস্থ কোনো কর্মকর্তার এখানে আগমন ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তা এখানে সম্পূর্ণভাবে বিঘ্নিত। উন্নত অথবা বড় আকারের কোনো সামরিক হেলিকপ্টার পর্যন্ত অবতরণ সম্ভব ছিল না। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা এবং বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ভারতে অবস্থান করছিলেন। পাশাপাশি মাত্র ৩০০ জন নৌ কমান্ডোর প্রশিক্ষণ পর্যবেক্ষণ এবং তাদের দেশপ্রেম জাগ্রত করতে ভারতের মতো বিশাল দেশের নৌবাহিনী প্রধানের ক্যাম্পে পদচারণ তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু তিনি নিজের পরিচয় দেননি। নৌযোদ্ধাদের কাছে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত।’

প্রশিক্ষণ সম্পর্কে খলিলুর রহমান আরও লেখেন, শরীরে লিমপেট মাইন বেঁধে নদীতে চলাচল এবং সহজে বহনযোগ্য কার্যকর বিস্ফোরক বহন ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাঁদের। জুলাই মাসের শেষ দিকে প্রশিক্ষণ শেষ হয়।

মিহির কুমার রায় তাঁর ওয়ার ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশান গ্রন্থে লিখেছেন, সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধারা শারীরিক-মানসিক উভয় দিক থেকেই ছিলেন সাহসী। সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধারা যেসব অঞ্চলে অভিযান চালাতেন, সেখানকার ভূগোল থাকত তাঁদের নখদর্পণে। তাঁরা খুব অল্প অস্ত্রশস্ত্র বহন করতেন। ফলে সহজেই তাঁরা লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় থাকতেন জোয়ার অথবা ভাটার, পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যার।

পানির নিচে শ্বাস নেওয়ার উন্নত যন্ত্র তাঁদের ছিল না। এ কাজে ব্যবহার করতেন বাঁশের এবং পেঁপেপাতার চোঙা। তাঁদের বিশেষ কোনো পোশাক ছিল না। লুঙ্গি আর বেনিয়ান পরেই অভিযানে যেতেন।

অপারেশন জ্যাকপট ছাড়া আরও অনেক অভিযান চালিয়েছেন এই সাঁতারু মুক্তিযোদ্ধারা। মিহির রায় বলেছেন, এই সামান্য অস্ত্রসরঞ্জাম নিয়েই বাঙালি সাঁতারু মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা যে অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন, শত্রুপক্ষের যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছেন, তা পৃথিবীর গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।

অভিযানের ফল

এই অভিযানের ফলে দুটি লাভ হয়েছিল। প্রথমত, পণ্য ও অস্ত্র পরিবহনের প্রধান পথ ছিল নৌপথ। এই অভিযানে তা হুমকির মধ্যে পড়ল। নিরাপত্তার কারণে চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরে বিদেশি জাহাজ আসতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, একসঙ্গে অনেকগুলো বিদেশি জাহাজ ধ্বংস হওয়ার খবর ফারইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একযোগে প্রকাশিত হয়। তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়ে। মার্চে শুরু করা গণহত্যার কথা তারা বরাবরই অস্বীকার করে আসছিল। তারা বলছিল, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। অপারেশন জ্যাকপট পাকিস্তানের সে প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রচারণা আরও বিশ্বাসযোগ্যতা ও গতি পায়।

সূত্র:

১. মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযান, কমান্ডো মো. খলিলুর রহমান, সাহিত্য প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ: এপ্রিল ২০১১

২. ওয়ার ইন দ্য ইন্ডিয়ান ওশান, মিহির কুমার রায়, ল্যান্সার পাবলিশার, ১৯৯৫

৩. অপারেশন এক্স, এম এন আর সামন্ত ও সন্দীপ উন্নিথান, হারপার কলিন্স পাবলিশার্স ইন্ডিয়া, ২০১৯

৪. প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট, ২০২১