
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির সঙ্গে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটরের উদ্দেশে বিচারপতি বলেন, ‘কথায় কথায় দাঁড়িয়ে যান কেন?’ চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বাগ্বিতণ্ডায় জড়ান আসামিপক্ষের আইনজীবী তাবারক হোসেনের সঙ্গেও।
আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই ত্রিপক্ষীয় বাদানুবাদ হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১-এর অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম।
ট্রাইব্যুনালে আজ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে গুম করে রাখার ঘটনায় করা মামলায় বর্তমান ও সাবেক ১২ কর্মকর্তাসহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হয়।
এরপর ট্রাইব্যুনালের কাছে সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিন মাস সময় চান গ্রেপ্তার সাত সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী তাবারক হোসেন। তিনি বলেন, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) থেকে তাঁদের প্রচুর নথিপত্র দেওয়া হয়েছে। সেগুলো পড়তে হবে, বুঝতে হবে। প্রসিকিউশনের সাক্ষীরা কী বলেছেন, সেসব পড়তে হবে। তাঁদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে হবে।
নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা তুলে ধরার পাশাাশি তাবারক হোসেন বলেন, লিখিত আদেশ পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন তাঁরা। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া তাঁর মক্কেলদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তখন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন আদেশের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের গ্রাউন্ড বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
তাৎক্ষণিকভাবে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদের এ কথার আপত্তি জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলেন, প্রসিকিউশনের কথা শুনে অর্ডার দিতে হবে। উনি (তাবারক হোসেন) রিভিউ করবেন, সে জন্য কি ট্রায়াল বসে থাকবে?
চিফ প্রসিকিউটরের উদ্দেশে তখন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, ‘আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আপনি যেভাবে কথা বলেন, আদালতে এভাবে কথা বলে না। যতক্ষণ না আদেশ পাস করা হচ্ছে, আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না। আমরা কথা বলব, আপনি কথা বন্ধ করবেন? আমরা অর্ডার দিয়েছি?’
আবার চিফ প্রসিকিউটর তাঁদের কথা শুনে আদেশ দেওয়ার কথা বলেন। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার বলেন, ‘চিফ প্রসিকিউটর, আপনি বসেন।’
তারপর বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, ‘আমরা আপনাকে শুনি না? আপনি কথায় কথায় দাঁড়িয়ে যান কেন?’
তখন চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আপনি যদি অর্ডার পাস করে দেন।’
এর জবাবে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, প্রসিকিউশনের কথা না শুনে তাঁরা কোনো দিন আদেশ পাস করেননি।
পরে শুনানির শেষ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একজন শেষ না করতে আরেকজন দাঁড়িয়ে যাওয়া খুবই অপ্রত্যাশিত। ট্রাইব্যুনাল আশা করবে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না।
‘মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে ট্রায়াল করতে হচ্ছে’
আসামিপক্ষকে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য চার সপ্তাহ সময় দেওয়ার কথা জানান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। তখন চূড়ান্ত আদেশ দেওয়ার আগে তাঁর কথা শোনার জন্য বলেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। পরে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য বলেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল আইনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন থেকে সূচনা বক্তব্যের দিন পর্যন্ত ন্যূনতম তিন সপ্তাহ সময় দেওয়ার কথা বলা আছে। এই তিন সপ্তাহের বেশি সময় যেন না দেওয়া হয়, তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। তাজুল ইসলাম বলেন, আসামিপক্ষ চাচ্ছে এই মামলা ‘ড্র্যাগ’ (ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা) করার, যাতে বিচার না হতে পারে।
একপর্যায়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘সাক্ষীদের হত্যা করা হচ্ছে। চাকু মারা হচ্ছে। মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে ট্রায়াল করতে হচ্ছে। এর (বেশি সময় চাওয়ার) উদ্দেশ্য ভালো না। যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে; যদি সাক্ষীকে মেরে ফেলে, তাহলে বিচার করবেন কীভাবে?’
তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, তাঁরা এখানে সেনাবাহিনীর বিচার করছেন না। তাঁরা বিচার দীর্ঘায়িতও করবেন না।
আপনি বসেন, তাবারককে তাজুল
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তখন পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেন মামলাটির গ্রেপ্তার সাত সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী তাবারক হোসেন। তিনি বলেন, চিফ প্রসিকিউটরের কথা সঠিক নয়। তাঁরা বিচারকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন না। যেটুকু সময় প্রয়োজন, তা চাচ্ছেন। তাঁরাও অভিযোগ করতে পারেন, চিফ প্রসিকিউটর তাড়াহুড়ো করে বিচার করতে চাইছেন।
তখন আইনজীবী তাবারকের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আপনি বসেন। আপনি এখানে কথা বলছেন কেন?’
এরপর ট্রাইব্যুনাল উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এ মামলায় সূচনা বক্তব্য শুরুর আগে চার সপ্তাহ সময় দেন।
একপর্যায়ে আইনজীবী তাবারক হোসেন বলেন, তাঁরা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘উনি (চিফ প্রসিকিউটর) কি বলতে পারেন—আপনি বসেন। কথা বলার সময় উনি পেছন থেকে ডিক্টেট করেন। এটা আদালতের নর্ম নয়। তাঁর (তাবারক) বয়সকেও উনি (চিফ প্রসিকিউটর) সম্মান করেননি। ‘ট্রাইব্যুনালের কাছে বিচার দিলাম।’
‘হ্যাপি জানাজা’
টিএফআই সেলে গুমের মামলার পর মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে করা আরেকটি মামলার শুনানি হয়। এ মামলায় জিয়াউলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শতাধিক ব্যক্তিকে গুম করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ মামলায় আজকে জিয়াউলকে হাজির করা হয়। তাঁকে ট্রাইব্যুনাল এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য ৪ জানুয়ারি দিন ধার্যের জন্য আবেদন করা হয়।
তখন হাসিমুখে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ বলেন, তাঁদের যেন ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ (খ্রিষ্টীয় নববর্ষ) পালনের সুযোগ দেওয়া হয়।
এর জবাবে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম বলেন, সে কারণেই তাঁরা এক সপ্তাহ মামলা রাখেননি।
এ সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কখন হ্যাপি নিউ ইয়ারের জায়গায় হ্যাপি জানাজা হয়ে যায়!’
একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালকে ইংরেজি নববর্ষের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান চিফ প্রসিকিউটর।