
নিকানো উঠান মাড়িয়ে লাল রঙের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় উঠতে উঠতে মন হারিয়ে যায়। কে বলবে এটা মাটির ঘর! এক গবেষকের ভাষায় এই স্থাপত্য হচ্ছে ‘প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া শান্তিপ্রিয় সৌন্দর্য।’ বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে বিশেষ করে নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় আছে এ রকম অসংখ্য মাটির বাড়ি।
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটি খুঁড়লে স্তরে স্তরে পাওয়া যায় নানা রঙের মাটি। মাটির বাড়ি রং করা হয় সে মাটি দিয়ে। অনেকে এই মাটি বিক্রিকে পেশা হিসেবেও নিয়েছেন। মাটির রঙে রঙিন বাড়ি এই এলাকার ঐতিহ্য। রাজশাহী আর চাঁপাইনবাবগঞ্জেও দেখা যায় কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের বাড়ি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক শাহরিয়ার হোসেন চারুকলার প্রাক্তন ছাত্র। নিজের অনুসন্ধান থেকে সম্প্রতি নওগাঁর মাটির বাড়ি নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন। তিনি জানালেন, মাটি আর আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্যের কারণে এ অঞ্চলের গ্রামীণ স্থাপত্যের প্রধান উপকরণ মাটি। শক্ত আর আঠালো হওয়ায় এ মাটি দিয়ে একতলা–দোতলা বাড়ি বানানো এখানকার প্রাচীন রীতি। মাটির ঘরে দারুণ আরাম। গ্রীষ্মকালে শীতল, শীতকালে উষ্ণ।
বেশির ভাগ মাটির বাড়ির নকশা প্রায় একই রকম। একটি বা দুটি শয্যাঘর, একটি বারান্দা, একটি উঠান। বারান্দায় ঢোকার মুখ সামান্য উঁচু। স্থানীয় লোকেরা একে বলে পিড়্যা (বাইরের বারান্দা)। এলাকা ঘুরে বাড়িগুলোর এসব বৈশিষ্ট্য উপভোগ করা গেল। এসব বাড়ি ধনী-গরিব সবারই আবাস।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের মাটির বাড়িটি এখন এলাকার গর্ব ও প্রতীক। বাড়িটিতে কক্ষ মোট ১২টি। বাড়ির সামনে ঐতিহ্যবাহী মাটির গোলাঘর।
গতকাল (৩ মে) বজলুর রহমানের বড় ভাই সাইদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এ বাড়ির অন্দরের অংশ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর দাদার দাদা হাজি ইয়াসিন আলী। বাড়ির সে অংশটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। অংশটি অটুট আছে।
প্রায় ১৩০ বছর আগে রাজশাহীর তানোর উপজেলার চোরখৈর গ্রামের সে সময়ের জমিদার কিসমত উল্লাহ চৌধুরী মাটির একটি ডুপ্লেক্স বা দোতলা অন্দরের বাড়ি তৈরি করেছিলেন। সে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেটির উত্তর পাশের তোরণ দিয়ে ঢুকতে বাঁ পাশে হাতির বাচ্চার ঘরটি শুধু ভেঙে পড়েছে। বাকি সব অবিকল। কাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক আসবাবও সেখানে ঢুকে পড়েছে। জমিদারের নাতি বর্তমানে কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাদেমুন নবী চৌধুরী এবং তাঁর ভাই সাদেকুন নবী চৌধুরী সেখানে সংসার করছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঝিকরাপাড়া গ্রামে কানাডাপ্রবাসী চলচ্চিত্র–গবেষক মনিস রফিকের বাড়ি। দোতলা এই বাড়ির বয়স প্রায় দুই শতাব্দী। বাড়িটি এখনো টিকে আছে। মনিস রফিকের নিকটাত্মীয় স্থানীয় ইউপি সদস্য মঈদুর রহমান বললেন, তাঁরা এখনো এখানে বসবাস করছেন। তবে ধেড়ে ইঁদুরের দৌরাত্ম্যে বাড়ি ক্ষয়ে যাচ্ছে। ভাঙা অংশ আর ঠিক করা হচ্ছে না।
মাটির বাড়িতে সুন্দর নকশা এঁকে সেটিকে রীতিমতো শিল্পকর্ম করে তুলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের টিকইল গ্রামের দেখন বালা নামের এক গৃহিণী। গণমাধ্যম এই বাড়িকে দর্শনীয় স্থান করে তুলেছে। বাড়িটির দেয়ালের নকশা দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, শুধু দেখন বালার নয়, গ্রামের সব বাড়ির দেয়ালই নকশাময়। মাটির রঙে ঘর রাঙানো এখানকার রীতি।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের জাহিদুর রহমান ও জাবেদ আলী মোল্লার ১৯৮০–এর দশকে তৈরি করা মাটির বাড়িতে গেলে দুদণ্ড বসতে ইচ্ছা করবেই। লাল মাটি দিয়ে নিকানো উঠোন, বারান্দা আর সিঁড়ি। ঘরে ঢুকে মনে হলো প্রাকৃতিকভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাড়ি। বাইরে দাবদাহ তুচ্ছ করে প্রাণ জুড়িয়ে দিল।
সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো অধ্যাপক শাহরিয়ারের একটি উদ্ধৃতি, ‘এই ঘর যেন গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের বাইরেও এক ভাবলোকের মায়া তৈরি করেছে।’