বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের নতুন প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের নতুন প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে

এমআইসিএস জরিপের তথ্য

প্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে

  • অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম বেড়েছে ১৬%

  • স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসব বেড়েছে ১৮%

  • স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর হার বেড়েছে ২%

  • শিশুশ্রম বেড়েছে ২%

  • জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার কমেছে ৫ শতাংশ

  • নবজাতক থেকে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু কমেছে

দেশে প্রতি দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় এ হার ৪ শতাংশ কমলেও বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি এখনো উচ্চপর্যায়ে। দেশে এখন ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৬০ শতাংশ থেকে নেমে ৫৬ শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালে প্রসব, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বেড়েছে। তবে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অস্ত্রোপচারে (সিজারিয়ান সেকশন বা সি–সেকশন) শিশু জন্মের হার। নবজাতক থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার কমেছে। শিশুশ্রম ও স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর হার বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের নতুন প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস–বহুনির্দেশক গুচ্ছ জরিপ) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন–মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ২ দফায় প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এখানে জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে ১৭২টি মানদণ্ড এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২৭টি সূচককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা, সিসাসহ ভারী ধাতুর দূষণের মাত্রা পরীক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ এমআইসিএসের প্রতিবেদনটি ছিল ২০১৯ সালের। ওই সময় থেকে কতটুকু অগ্রগতি বা অবনতি হয়েছে, তার তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে নতুন প্রতিবেদনে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। সম্মানিত অতিথি ছিলেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স।

রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, বাল্যবিবাহ ও শিশুমৃত্যুর হার প্রমাণ করে অগ্রগতি সম্ভব। সিসাদূষণ ও শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে। শিশুদের সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী। এমআইসিএসের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা এমদাদুল হক প্রতিবেদনের মূল তথ্য উপস্থাপন করেন। মুক্ত আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন বিবিএসের উপপরিচালক মো. আলমগীর হোসেন।

জরিপ প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহের দুটি উপাত্ত দেওয়া হয়েছে। একটি তথ্যে বলা হয়েছে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বাল্যবিবাহ হয়েছে ৪৭ শতাংশের, ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এ হার ছিল ৫১ শতাংশ। অপর দিকে দেশজুড়ে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশে, যেটা আগে ছিল ৬০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি দুটি কন্যাশিশুর মধ্যে প্রায় একটি কন্যাশিশু- মোট প্রায় ৩৬ লাখ কিশোরীর এখনো ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হচ্ছে। এর ফলে দেশের উৎপাদনশীলতা ও মানবসম্পদের সম্ভাবনায় বছরে ৭ থেকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমান গতিতে চললে বাল্যবিবাহ নিরসনে ৬৪ বছরের বেশি সময় লাগবে।

এমআইসিএস (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে) ২০২৫–এর প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে অতিথিরা। আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। ছবি: ইউনিসেফ বাংলাদেশ

জরিপে দেখা গেছে, কিশোরী মায়েদের সন্তান জন্ম দেওয়ার হার প্রতি হাজারে ৮৩ থেকে বেড়ে ৯২ হয়েছে। সি–সেকশন ২০১৯ সালের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে প্রসব ১৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ। শিশুশ্রম ২ শতাংশের বেশি বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার বয়সী শিশুদের স্কুলে না পড়ার হার ২ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার ৫ শতাংশ কমে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। মোট প্রজননহার (টিএফআর) ২ দশমিক ৩ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৪ হয়েছে।

অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করার সময় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, উন্মুক্ত উপাত্তের দিকে এমআইসিএসের এই প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা। বড় পরিসরে আলোচনার জন্য এই উপাত্ত যেন সহজলভ্য হয়। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে দুটো উপাত্ত এসেছে। নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে কোনটা ব্যবহার করা হবে, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। কোনো ক্ষেত্রে হার কেন বাড়ছে, কোনো ক্ষেত্রে কেন কমছে—সেই পেছনের গল্পগুলো উঠে আসা উচিত। জরিপের মান বাড়াতে হবে।

প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেস্‌ম, ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, সাবেক সচিব মো. সারোয়ার বারী এবং আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক থাডেয়াস ডেভিড মে।

বক্তারা নিরাপদ পানি সরবরাহে নগর ও গ্রামের বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেন। তাঁরা সি–সেকশনের উচ্চ হার কমাতে সরকারকে নজরদারিব্যবস্থা জোরদার করার আহ্বান জানান। এর বাইরে অনুষ্ঠানে আরও চারটি প্যানেল আলোচনা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বসয়ী শিশুদের পাঁচটি বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রতিটি ধাপে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে জীবিত জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে ৩৩টি মারা যায়, যা আগে ছিল প্রতি হাজারে ৪০।

খর্বকায় শিশুর হার ৪ শতাংশ কমে হয়েছে ২৪ শতাংশ। তবে র্শীণকায় শিশুর হার ৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। কম ওজনের শিশুর হার সামান্য বেড়ে ২৩ শতাংশ হয়েছে। অতি ওজনের শিশুর হার কিছুটা কমেছে।

প্রসবপূর্ব সেবা ৪ বার নেওয়ার হার ৪৩ শতাংশ। প্রসবপূর্ব সেবা অন্তত একবার নেওয়ার হার ৫৮ থেকে বেড়ে প্রায় ৭৬ শতাংশ হয়েছে। তবে মানসম্মত চারবার সেবা নেওয়ার হার এখনো অনেক কম, মাত্র ৪৩ শতাংশ।

৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৫৯ শতাংশের জন্মনিবন্ধন হয়েছে। এর ফলে অনেক শিশু আইনগত পরিচয় এবং সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

নতুন জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশের এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি। ঢাকা (৬৫ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা। সিসাদূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে হুমকি সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাব আর্থসামাজিক সব শ্রেণির ওপর পড়ছে। আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী এবং ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। পানীয় জলের প্রায় অর্ধেক উৎস এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশের বেশি নমুনা ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়াদূষিত। প্রতিবেদনে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, শিশুদের স্কুলে অনুপস্থিতির হার বাড়ার বিষয় তুলে ধরা হয়।