ইস্পাহানি মির্জাপুর বর্ষাযাপন ১৪৩২-এর বিশেষ আয়োজন ‘গান-কবিতায় বর্ষাযাপন’
ইস্পাহানি মির্জাপুর বর্ষাযাপন ১৪৩২-এর বিশেষ আয়োজন ‘গান-কবিতায় বর্ষাযাপন’

গান-কবিতায় বর্ষাযাপন: সুর আর আবৃত্তির মোহময় উপস্থাপনায় স্নিগ্ধ আয়োজন

বাংলায় বর্ষা মানেই এক ভিন্ন উদ্‌যাপন। বর্ষার সঙ্গে সংগীত ও সাহিত্যের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বাঙালিদের কাছে গান আর কবিতা ছাড়া বর্ষাকে উদ্‌যাপন যেন বরাবরই পানসে। তাই বর্ষা-১৪৩২ উপলক্ষে ইস্পাহানি মির্জাপুরের উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম আয়োজন করে ‘গান-কবিতায় বর্ষাযাপন’ শীর্ষক তিন পর্বের বিশেষ অনুষ্ঠান।

স্নিগ্ধ এ আয়োজনে বর্ষার গান শুনিয়েছেন সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার, খৈয়াম সানু সন্ধি ও মাশা ইসলাম। আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় ছিলেন যথাক্রমে আনিসুল হক, সাকিলা মতিন মৃদুলা ও মাহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানগুলো প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে।

বাপ্পার বর্ষার গান, সঙ্গে আনিসুল হকের আবৃত্তির মুগ্ধতা

প্রথম পর্বে সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার পরিবেশন করেছেন বৃষ্টি ও বর্ষা নিয়ে চারটি গান। উপস্থাপনার সঙ্গে কবিতায় প্রাণ সঞ্চার করেছেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। গান আর কবিতার পাশাপাশি বর্ষাকে ঘিরে তাঁদের নানান স্মৃতি, অনুভব আর ভাবনার প্রকাশে বিশেষ আবহ তৈরি হয় এই পর্বজুড়ে।

বর্ষার গান শুনিয়েছেন সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার, আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় ছিলেন আনিসুল হক

‘শাওন-রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/ বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বর্ষার বিখ্যাত এ গানের কথা বলতে বলতেই পর্বটি শুরু করেন আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে গানের দেশ, প্রাণের দেশ, কবিতার দেশ। এর পেছনে হয়তো বর্ষাকালের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে আনিসুল হক জানতে চান, বর্ষা ও সৃষ্টিশীলতার এ সম্পর্ক সংগীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার কীভাবে দেখেন?

বাপ্পা মজুমদার বলেন, ‘যাঁরা সৃষ্টিশীল মানুষ, বৃষ্টি ব্যাপারটি তাঁদের মধ্যে একধরনের প্রভাব ফেলে। বৃষ্টি আচ্ছন্ন একটি অনুভূতি বলে আমার কাছে মনে হয়। যা নানাভাবে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ পায়।’

বাপ্পা মজুমদার আরও জানান, তিনি বেশ কিছু গান লিখেছেন এমন সময়ে, যখন বৃষ্টি হচ্ছিল।

প্রসঙ্গত আনিসুল হক বলেন, ‘বর্ষার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক আসলে আমাদের রক্তে। আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি কাব্য “মেঘদূত”-এ যক্ষ মেঘকে বলেছেন প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে।’

আনিসুল হক বলেন, শুধু তা-ই নয়, প্রাচীন মধ্যযুগীয় কবিতাগুলোতে বারবার উঠে এসেছে বর্ষার কথা। রাধা-কৃষ্ণের মিথেও রয়েছে বর্ষা। রাধা কদমতলায় যাচ্ছেন, নীলাম্বরী শাড়ি পরছেন, কৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছেন। বর্ষা আমাদের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, ছোটগল্প, এমনকি তাঁর প্রবন্ধের মধ্যেও বর্ষা প্রবলভাবে উপস্থিত।

বর্ষা নিয়ে এমন নানান কথোপকথনের ফাঁকে ফাঁকে বাপ্পা মজুমদার শুনিয়েছেন তাঁর জনপ্রিয় গান ‘বৃষ্টি পড়ে’, ‘আজ বৃষ্টিমুখর দিন’, ‘অনেক বৃষ্টির পরে’ ও ‘বন্ধু তুমি ফিরে এসো’। পাশাপাশি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘অবনী বাড়ি আছো’সহ আনিসুল হক আবৃত্তি করেছেন তাঁর নিজের লেখা দুটি কবিতা ‘যদি কোনো দিন বৃষ্টি হয়’ ও ‘একদিন এই শহর ছেড়ে চলে যাব’।

প্রসঙ্গক্রমে বাপ্পা মজুমদার ‘যদি কোনো দিন বৃষ্টি হয়’ কবিতাটির পেছনের গল্প জানতে চান। উত্তরে আনিসুল হক বলেন, ‘এই যে আমরা নগরায়ণ করতে গিয়ে গাছগুলো কেটে ফেলছি, উন্নয়নের পেছনে ছুটতে গিয়ে নদীগুলো ভরাট করে ফেলছি, এই কবিতাটি আসলে সেটা ভেবেই লেখা।’

বর্ষার গান শুনিয়েছেন সংগীতশিল্পী খৈয়াম সানু সন্ধি, আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় ছিলেন সাকিলা মতিন মৃদুলা

সন্ধির গানে আর মৃদুলার আবৃত্তিতে ভিন্ন আবেশ

দ্বিতীয় পর্বে তরুণ কণ্ঠশিল্পী খৈয়াম সানু সন্ধি পরিবেশন করেছেন চারটি বর্ষার গান। উপস্থাপনার সঙ্গে কবিতা আবৃত্তি করেছেন সাকিলা মতিন মৃদুলা।

পর্বের শুরুতেই মৃদুলা বলেন, ‘বর্ষা এলেই প্রকৃতি এক অন্য রকম আবেশে মেতে ওঠে, সেই সঙ্গে মেতে উঠি আমরাও। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে বর্ষাকে কীভাবে উদ্‌যাপন করেন সন্ধি?’

উত্তরে সন্ধি বলেন, ‘বর্ষার শুরুতে মাটির সোঁদা গন্ধটাই আমাকে উন্মাদ করে তোলে। আর বৃষ্টি আসার আগমুহূর্তের যে বাতাসটা, সেটিও আমার অসম্ভব ভালো লাগে।’

সন্ধি জানান, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ঋতু হলো বর্ষা। বর্ষায় অনেক ধরনের সমস্যা হয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বৃষ্টি দেখতে তাঁর ভীষণ ভালো লাগে।

বর্ষার আরেকটি দারুণ ব্যাপার হলো, বর্ষা আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। আমরা হারিয়ে যাই পুরোনো দিনের স্মৃতিতে। তাই হয়তো বর্ষার কথা বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে ওঠেন কণ্ঠশিল্পী সন্ধি, ‘আমার বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা আসলে স্কুলজীবনে বর্ষায় জমে থাকা পানিতে যখন নৌকা ভাসাতাম, ঠিক তখন থেকেই। ছোটবেলায় বৃষ্টি এলেই আমরা স্কুল ফাঁকি দিতাম, মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম, মা খিচুড়ি আর ইলিশ রান্না করতেন। তবে সবচেয়ে সুখকর স্মৃতির মধ্যে ছিল ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা। এভাবেই ছিল ছেলেবেলায় বর্ষাযাপন।’

তরুণ বয়সে কীভাবে বর্ষাকে উদ্‌যাপন করতেন আপনি? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে সন্ধি হেসে বলেন, ‘তরুণ বয়সে আমার বর্ষা ছিল হুডতোলা রিকশায় প্রেম।’

বর্ষা নিয়ে এমন গল্প-কথনের ফাঁকে কণ্ঠশিল্পী সন্ধি পরিবেশন করেছেন তাঁর নিজের গান ‘বৃষ্টির স্কুল’; পাশাপাশি গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত ‘পাগলা হাওয়ার বাদল–দিনে’, শেখ ইশতিয়াকের ‘টিপ টিপ বৃষ্টি’ এবং অর্থহীন ব্যান্ডের ‘এপিটাফ’। সেই সঙ্গে সাকিলা মতিন মৃদুলা মিষ্টি কণ্ঠে আবৃত্তি করেছেন মহাদেব সাহার কবিতা ‘বর্ষা, বৃষ্টি কিংবা ভালোবাসার কবিতা’।

কণ্ঠশিল্পী সন্ধি প্রসঙ্গক্রমে মৃদুলার কাছে জানতে চান, তিনি কীভাবে বর্ষাযাপন করেন?

উত্তরে সাকিলা মতিন মৃদুলা বলেন, ‘ছোটবেলায় আমি আসলে নিজের ইচ্ছেমতো বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম না। এই বয়সে এসে ইচ্ছেমতো বর্ষাকে উদ্‌যাপন করতে পারি।’

বর্ষার গান শুনিয়েছেন সংগীতশিল্পী মাশা ইসলাম, আবৃত্তি ও উপস্থাপনায় ছিলেন মাহিদুল ইসলাম

মাশার মায়াবী সুরের সঙ্গে মাহির আবৃত্তির যুগলবন্দী

তৃতীয় ও শেষ পর্বে বর্ষার গানে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তরুণ কণ্ঠশিল্পী মাশা ইসলাম। সঙ্গে ভরাট কণ্ঠে মাহিদুল ইসলামের উপস্থাপনা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই মাহিদুল ইসলাম আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষার বিখ্যাত কবিতা ‘এমন দিনে তারে বলা যায়…’।

এরপর মাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্ষাকে একেকজন উদ্‌যাপন করেন একেকভাবে। শিল্পীদের থাকে বর্ষার মাঝেও নানা কাজ। কাজ না থাকলে কীভাবে বর্ষাকে উদ্‌যাপন করেন মাশা?’

মাশা বলেন, ‘বর্ষাদিনে কোনো কাজ না থাকলে এখানে (অনুষ্ঠানে) যেভাবে চা খাচ্ছি, সেভাবেই জানালার পাশে বসে চা খাই। মাঝেমধ্যে নিজেই চা বানাই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই।’

মাশার জীবনে কি বর্ষা নিয়ে এমন কোনো স্মৃতি রয়েছে, যেখানে তিনি আবার ফিরে যেতে চান? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে মাশা বলেন, ‘গ্রামে বর্ষাকাল এলে আমরা সবাই মিলে উঠানে বৃষ্টিতে ভিজতাম। সুযোগ পেলে সেই সময়টায় এখনই ফিরে যেতে চাই।’

প্রসঙ্গক্রমে মাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সময়ে বর্ষার উদ্‌যাপন ছিল একটু ভিন্ন রকম। বর্ষার দিনে আমরা ছেলেরা সবাই মিলে মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কান ধরে টেনে না তুলছে, ততক্ষণ পুকুরে সাঁতার কাটতাম, বৃষ্টিতে ভিজতাম। এভাবেই কাটত আমাদের বর্ষার দিনগুলো।’

সংগীতশিল্পী হিসেবে বৃষ্টি বা বর্ষা মাশার জীবনে প্রভাব ফেলে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাশা বলেন, ‘বৃষ্টি এলে তো একটু আলাদা আবেগ কাজ করেই। তখন মন চায় একটু গান লিখি, গানে সুর দিই কিংবা গান গাই।’

বর্ষা নিয়ে গল্পের ফাঁকে মাশা ইসলাম শুনিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের ‘এই মেঘলা দিনে একলা’, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘আকাশ এত মেঘলা যেয়ো নাকো একলা’ এবং রুনা লায়লার ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে’ গানগুলো।

মাহিদুল ইসলাম আবৃত্তি করেছেন মোফাজ্জল করিমের লেখা ‘বৃষ্টি মানে’ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা ‘মধ্যরাতে বৃষ্টি’ শিরোনামের কবিতা।