গান, আবৃত্তি, আলোচনা ও স্মৃতিচারণা এবং রচনা থেকে পাঠের মধ্য দিয়ে সরদার ফজলুল করিমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে
গান, আবৃত্তি, আলোচনা ও স্মৃতিচারণা এবং রচনা থেকে পাঠের মধ্য দিয়ে সরদার ফজলুল করিমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে

জন্মশতবর্ষে আলোচনা

সরদার ফজলুল করিমের চিন্তা কালজয়ী হয়ে থাকবে

সত্যিকারের গুণীজন আমাদের সমাজে বেশি নেই। যাঁদের চিন্তাচেতনা, জীবনদর্শন সমাজকে আলোকিত করে, জাতিকে অগ্রযাত্রার পথ দেখায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়, প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে অনুপ্রাণিত করে, তেমনই একজন  মনীষী ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে তিনি আর সশরীর নেই; কিন্তু তাঁর কাজ ও আদর্শ কালজয়ী হয়ে থাকবে—এমন মন্তব্য করে শ্রদ্ধা জানানো হলো তাঁর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে শুক্রবার বিকেলে ‘মনীষী সরদার ফজলুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী’ উদ্‌যাপনের আয়োজন করা হয়েছিল। গান, আবৃত্তি, আলোচনা ও স্মৃতিচারণা, রচনা থেকে পাঠের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় তাঁকে। আয়োজন করেছিল সরদার ফজলুল করিম স্মৃতি পরিষদ। ১৯২৫ সালের পয়লা মে তাঁর জন্ম। আয়োজকেরা জানান, মে দিবসের কারণে এক দিন পরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

‘মনীষী সরদার ফজলুল করিমের জন্মশতবার্ষিকী’র অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক–শ্রোতাদের একাংশ। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে

বাঁশিতে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ গানের সুরবাদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। বাদন করেছেন এস এম মকবুল হোসেন। পরে ‘আগুনের পরশমণি’ গেয়ে শুনিয়েছেন তাপসী রায়। অনুষ্ঠানে কোনো সভাপতি ছিলেন না। মঞ্চে কোনো আসন পাতাও হয়নি। নাম ঘোষণার পর বক্তারা মঞ্চে গিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন। ফাঁকে ফাঁকে ছিল আবৃত্তি, সরদারের লেখা থেকে পাঠ ও গান।

সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে আলোচনা করেন প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে

আলোচনা পর্বে প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সরদার ফজলুল করিম ছিলেন অসাধারণ গুণী মানুষ। নানা ঘাত–প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন অতিক্রান্ত হয়েছে। বৈরাগ্য ও জীবনের প্রতি ভালোবাসার মিশ্রণ ছিল তাঁর জীবনসাধনায়। ব্যক্তিগতভাবে উজ্জ্বল জীবনগঠনের সুযোগ পেয়ে তা ত্যাগ করেছেন গণমানুষের মুক্তির জন্য কাজ করতে গিয়ে। তাঁর রচনা জাতির সম্পদ। তিনি যে ‘দর্শনকোষ’ রচনা করেছেন, তা একক কারও পক্ষে করা খুবই দুরূহ। মার্ক্সবাদী হয়েও তিনি সক্রেটিস ও প্লেটোর মতো দার্শনিকদের গভীর অনুরাগী ছিলেন। তাঁদের রচনাবলি অনুবাদ করেছেন। সরদারের এসব রচনা থেকে প্রজন্মপরম্পরা প্রগতির পথে অনুপ্রাণিত হবে।

সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে দীর্ঘ জীবনের সখ্যের বিভিন্ন স্মৃতিচারণা করেন অধ্যাপক এম এ আজিজ মিয়া। তিনি বলেন, সরদার চিন্তার ক্ষেত্রে সক্রেটিসের প্রশ্নোত্তরপদ্ধতি অনুসরণ করতেন। তাঁর কাছে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তাঁকে প্রশ্ন করতে বলতেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি ওই বিষয়ে আলোচনা ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতেন। এতে জানতে আগ্রহীদেরও সমগ্র বিষয় উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যেত। তিনি সরদারের বেশ কিছু ভিন্ন গুণের কথা উল্লেখ করে শ্রোতাদের জানান, সরদার একসময় কবিতাও লিখেছেন এবং অভিনয় করেছেন। এটা অনেকেরই অজানা। সরদারের অভিনয়ের বিষয়টি সম্প্রতি প্রয়াত সংগীতজ্ঞ সন্‌জীদা খাতুনও তাঁর এক স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধে লিখেছিলেন।

সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক এম এম আকাশ। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে

সরদার ফজলুল করিমের রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি বলেন, বিপ্লবী মানবতাবাদ ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, যত প্রতিবন্ধকতা আসুক, মানুষ এগিয়ে যাবেই। সে কারণে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

লেখক ও সমাজচিন্তক কাজী মোহাম্মদ শীষ বলেন, যখন চারদিকে হতাশা ও অন্ধকার ঘিরে আসে, তখন তাঁর রচনা আলোকবর্তিকার মতো কাজ করে। তাঁর রচনা যে–ই পাঠ করবেন, তিনি অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হবেন। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকদের রচনা তিনি এমন সাবলীল ভাষায় ভাষান্তর করে আমাদের দেশের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন যে তা অনায়াসে সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়েছে। তাঁর রচনা পাঠকদের মোহগ্রস্ত করে রেখেছে।

সরদার ফজলুল করিমকে নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, তিনি যে সময় ও পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন, সেটি ছিল একটি কঠিন সময়। তিনি নিজেকে আলোকিত করার মধ্য দিয়ে সমাজকে আলোকিত করেছিলেন। এখন আবার এক কঠিন সময় এসেছে। সত্য মিথ্যায় এবং মিথ্যা সত্যে পরিবর্তিত হচ্ছে। এই  পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর চিন্তাভাবনা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই দিক নিয়ে ভাবতে হবে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন অধ্যাপক হারুন রশীদ, অধ্যাপক বদিউর রহমান, শিক্ষাবার্তা সম্পাদক এ এন রাশেদা, সমাজকর্মী সুব্রত ভট্টাচার্য, স্থপতি ইকবাল হাবিব, পরিবারের ঘনিষ্ঠজন কাজী তামান্না, কথাপ্রকাশের প্রকাশক মো. জসিমউদ্দিন, গবেষক ও সরদার ফজলুল করিমের দিনলিপির সম্পাদক মার্জিয়া লিপি।

আলোচকেরা বলেন, সরদার ফজলুল করিমের মতো মানুষের জন্মশতবর্ষ দেশব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে প্রকৃত গুণীর কদর নেই। এ বছরের মধ্যে কোনো সুবিধাজনক সময়ে অন্তত ঢাকায় জাতীয়ভাবে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানান তাঁরা।
অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানান ডা. শাকিল আক্তার। সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক স্বপন নাথ।

আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে কবিতা আবৃত্তি করেন মাকসুদ খান ও ফাতেমা ফারজানা। রচনা থেকে পাঠ করেন অনন্যা গোস্বামী। গান গেয়ে শুনিয়েছেন রাজীব আহমেদ, মনসুর রহমান, ত্রিধারা সাহা ও অনিন্দিতা রক্ষিত। বাঁশিতে ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানের সুর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় স্মৃতি ও শ্রদ্ধার এই অনবদ্য আয়োজন।