নবান্ন উৎসবে বাউলসংগীত পরিবেশন। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি
নবান্ন উৎসবে বাউলসংগীত পরিবেশন। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

ইস্পাহানি পার্বণ নবান্ন উৎসব

কালীগঙ্গার সাইংজুরি গ্রাম মেতেছে নবান্ন উৎসবে

ঝিরিঝিরি বাতাস বয়ে যাচ্ছে কালীগঙ্গা নদীর বুক ছুঁয়ে। শীত এবার বেশ দুর্বল। ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’ বলে যে প্রবাদ, তার প্রমাণ পাওয়া গেল না এখানে। বরং নদীর তীর ধরে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে মেঘ-কুয়াশাবিহীন আকাশ থেকে দীপ্তিমান সূর্য উদারভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে তার তপ্ত কিরণ। তেতে ওঠা রোদে গায়ে গরম কাপড় রাখাই দায়। নদীর পশ্চিম তীরে জমজমাট নবান্ন উৎসবে মুখর আশপাশের কয়েক গ্রামের শিশু, নর–নারী গরম কাপড় ছাড়াই মেতে উঠেছেন পিঠাপুলি, লোকগান, খেলাধুলার প্রতিযোগিতাসহ হরেক রকম আয়োজনে।

মুখে চামচ নিয়ে ভারসাম্য রক্ষার দৌড়ে শিশুরা। দেখি, কে জয়ী হয়! ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

আজ শনিবার সকাল থেকে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সাইংজুরি গ্রামে রামেশ্বরপট্টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়–সংলগ্ন কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে শুরু হয়েছে ইস্পাহানি পার্বণ নবান্ন উৎসব-১৪৩১। ইস্পাহানির ব্র্যান্ড ‘পার্বণ’-এর উদ্যোগে প্রথম আলো ডটকম এ উৎসবের আয়োজন করেছে।

ইস্পাহানি মূলত চায়ের জন্য সর্বাধিক পরিচিত হলেও তারা সম্প্রতি চালসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন ও বিপণন করছে। তাদের চালের নাম ‘পার্বণ’। এই পার্বণের সহায়তায় গ্রামীণ পরিবেশে এখানে এবার দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে দিনব্যাপী নবান্ন উৎসব।

আহ, নাগরদোলা! নাগরদোলায় উঠতে পেরে খুশি ওরা। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

সবাই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়াল খান। তিনি বলেন, ইস্পাহানি ও প্রথম আলোর আয়োজনে গত বছর থেকে তাঁদের গ্রামে ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব করছে—এটা খুবই আনন্দের বিষয়। তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।

ইস্পাহানির উপমহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) এইচ এম ফজলে রাব্বি বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী লোক–উৎসবগুলো ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন নতুন প্রজন্মের কাছে এসব উৎসবকে তুলে ধরতে। সেই লক্ষ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। নিয়মিত এ উৎসব আয়োজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী একজন পুরস্কার নিচ্ছেন। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

ইস্পাহানির এগ্রো প্রসেসিং ইউনিটের ব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ইস্পাহানি প্রায় দুই শ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে চা উৎপাদন ও বিপণন করে আসছে। এখন তারা জনসাধারণের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান দিতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন করছে। ‘পার্বণ’ নামে তাদের উন্নত মানের সুগন্ধি চিনিগুঁড়া, তুলসীমালা, কালিজিরা, কাটারিভোগ এবং ভাতের জন্য নাজিরশাইল, বাংলামতি, জিরাশাইল ও বিআর-২৮ চাল রয়েছে।

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘এই উৎসব নারী–পুরুষ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের সব বয়সী মানুষের। সকাল থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলবে। এতে অংশ নিয়ে আমরা সবাই বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে উদ্‌যাপন করব।’

ফুটবল গর্তে ফেলার প্রতিযোগিতা ঘিরে আগ্রহ ছিল সবার। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

মৌসুমী মৌয়ের সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী পর্বের পর শুরু হয় মানিকগঞ্জের লোকশিল্পীদের পরিবেশনায় লোকসংগীতের পালা। লোকসংগীত আর পিঠাপুলির জন্য মানিকগঞ্জের খ্যাতি দেশজোড়া। প্রথমেই আসলাম উদ্দিন ও তাঁর দলের শিল্পীরা পরিবেশন করেন বৈঠকি গান। ‘আমার অন্তর কান্দিয়া ওঠে ওই সোনার বন্ধুর লাগিয়ারে’, ‘আমি কি আর আমার আছি’—এমন একের পর এক গানের বিরহ–ব্যথার সুর ভেসে যায় নদীর পাড় দিয়ে, হলুদ শর্ষেখেত, সবজির সবুজ মাঠ পেরিয়ে দিগন্তের পানে। মরমি আবহের সৃষ্টি করে উৎসবে।

বৈঠকি গানের পর গাজির গান পরিবেশন করে আওলাদ গায়েন ও তাঁর দল। ওদিকে মঞ্চে যখন গান চলছিল তখন নদীর তীরে জমে ওঠে শিশু ও নারী–পুরুষের জন্য মজার মজার খেলার প্রতিযোগিতায়। এগুলোর মধ্যে ছিল ভারসাম্য দৌড়, বস্তাদৌড়, নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে গর্তে ফুটবল ফেলা, রিংনিক্ষেপ, রশি–টানাটানি। বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার ছিল বিভিন্ন পরিমাণের পার্বণ চিনিগুঁড়া চালের প্যাকেট।

গ্রামীণ জীবনে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের নানা কিছু স্থান পেয়েছে নবান্ন উৎসবের এই স্টলে

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে নদীর পশ্চিম পাড়ে রঙিন কাগজের ঝালর টাঙিয়ে বর্ণাঢ্য পরিবেশের আবহ তৈরি করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে বসেছে স্টলের সারি। সেখানে রয়েছে হরেক রকমের কৃষি ও কারুপণ্যের সামাহার। এক পাশে আছে নাগরদোলা। বায়োস্কোপ, বানর আর সাপের খেলা দেখাতেও এসেছিলেন এসব পেশায় নিয়োজিত স্থানীয় লোকজন। আর সকাল থেকেই ছিল গরম পিঠাপুলি আর চায়ের ব্যবস্থা। খেলাধুলার আয়োজন শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে আসে। অনুষ্ঠানে বিরতি দিয়ে গরম খিচুড়ির আয়োজন করা হয় উপস্থিত সবার জন্য।

দুপুরের পর থেকে আশপাশের রামেশ্বরপট্টি, কাউটিয়া, জাবরা, বানিয়াজুড়ি, শিমুলিয়াসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে বিভিন্ন বয়সের নারী–পুরুষ আসতে থাকেন নবান্ন উৎসবে।

নবান্ন উৎসবে বানরের কসরত দেখতে ভিড়। ঘিওর, মানিকগঞ্জ, ১৮ জানুয়ারি

রামেশ্বরপট্টি গ্রাম থেকে দুই নাতিকে সঙ্গে নিয়ে উৎসবে এসেছেন বৃদ্ধ মোবারক হোসেন। তিনি বললেন, গত বছর থেকে নদীর পাড়ে এই উৎসব হচ্ছে। গ্রামে এখন আর আগের মতো নবান্নের উৎসব হয় না। এই উৎসবে অংশ নিয়ে তাঁর খুব ভালো লেগেছে। তাঁর নাতিরা খুবই আনন্দ করছে।

বিকেলের অনুষ্ঠান শুরু হয় মানিকগঞ্জের স্থানীয় ব্যান্ড ‘বিদ্রোহী’র পরিবেশিত গান দিয়ে। এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় কুইজ প্রতিযোগিতা। এরপর স্ট্যান্ডআপ কমেডি পরিবেশন করবেন এমদাদুল হক হৃদয়। অভিনয় করবেন শাহনাজ খুশী। শেষে গান শোনাবেন জনপ্রিয় শিল্পী সুমী শবনম।