
১. যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় চিফ প্রসিকিউটর বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘প্রাণভোমরা’ ছিলেন শেখ হাসিনা।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ‘গ্যাং অব ফোর’–এর সদস্য এবং ‘কমান্ডার অন দ্য গ্রাউন্ড’ উল্লেখ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর।
চানখাঁরপুলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা মামলায় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে জেরা।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’ ছিলেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় বৃহস্পতিবার পঞ্চম ও শেষ দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে এই নিউক্লিয়াস বা ‘প্রাণভোমরা’কে অবশ্যই বিচারিক প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। এই নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের অপরাধের নিউক্লিয়াস কেউ হতে না পারে।
শেখ হাসিনাকে আইনে বর্ণিত সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) দিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আরজি জানান চিফ প্রসিকিউটর। এ সময় তিনি আরও বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের যেসব সদস্যের পাশাপাশি ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ) ও যুবলীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) লোকেরা হামলা করেছেন এবং সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা জড়িত হয়েছেন, প্রত্যেকের প্রাণভোমরা ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত—তাঁরা এমনটি মনে করতেন।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এই প্রথম কোনো মামলায় যুক্তিতর্ক শেষ করল প্রসিকিউশন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সমাপনী দিনে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য যদি একবার করেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে শেখ হাসিনার ১ হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু একজন মানুষকে সেটা দেওয়া যায় না। ভুক্তভোগীদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে, যদি শেখ হাসিনাকে অবশ্যই চরম দণ্ডটা দেওয়া হয়।
গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেখ হাসিনার বিভিন্ন কল রেকর্ড ভাইরাল হচ্ছে বলেও যুক্তিতর্কে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, এত মানুষ হত্যার পরও তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো মানুষ হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাগুলো তিনি বারবার বলছেন। তাঁর প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই মামলার বিচার চলছে। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে ‘গ্যাং অব ফোর’–এর সদস্য উল্লেখ করে যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তাঁর (আসাদুজ্জামান) বাসায় ‘কোর কমিটির’ সভা বসত। তিনি সবকিছু জানতেন, পরিকল্পনা করতেন। শিশুদের যখন মারা হচ্ছিল, তখন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিষয়টিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আইজিপিকে বলেছেন ‘লেথাল উইপন’ (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের জন্য।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান, আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান—এই চারজন হলেন গ্যাং অব ফোর।
‘কমান্ডার অন দ্য গ্রাউন্ড’ (মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া) হিসেবে আসাদুজ্জামান খান কাজ করতেন উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এই আসামি কোনো অনুকম্পা পাওয়ার অধিকারী নন। আসাদুজ্জামানকেও চরম দণ্ড দিতে ট্রাইব্যুনালের প্রতি আরজি জানান তিনি।
এ মামলার আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী নামে পরিচিত) হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শর্ত হচ্ছে, যদি তিনি (মামুন) ‘ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার’ (পূর্ণ সত্য প্রকাশ) করেন তাহলে অ্যাপ্রুভার হিসেবে গণ্য হবেন। সাবেক আইজিপি মামুন সাক্ষ্য দিয়েছেন। যত দূর সম্ভব তিনি ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার করেছেন বলে তাঁরা মনে করেন। তিনি শুধু জুলাইয়ের এ মামলা নয়, গুমসহ অন্যান্য অপরাধের ব্যাপারেও তথ্য দিয়েছেন। সেটাকে যদি ট্রু অ্যান্ড ফুল ডিসক্লোজার মনে করেন ট্রাইব্যুনাল, তাহলে যথাযথ আদেশ তাঁর ব্যাপারে দিতে পারেন।
শেখ হাসিনাসহ এ মামলার আসামিদের সম্পদ থেকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে হতাহতের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, আসামিরা বৈধ ও অবৈধভাবে বিপুল বিত্ত–বৈভবের মালিক হয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রের সম্পদকে লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন। দেশের মধ্যে অঢেল সম্পত্তি গড়েছেন। এই সম্পত্তি থেকে গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আবেদন জানান তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি শর্ত হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অথবা সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে এটি সম্পূর্ণরূপে করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হয়েছিল।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যদিও সেনাবাহিনী সেভাবে অ্যাক্ট (ভূমিকা পালন) করেনি। ছাত্রদের সেভাবে হত্যা না করার ব্যাপারে সভা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। শেষের দিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র–জনতা একাকার হয়ে গেছে। মিরপুরের একটা জায়গায় দেখা গেছে, ছাত্রদের রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি করেছে পুলিশের দিকে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেষ পর্যন্ত দেশকে রক্ষার জন্য মাঝখানে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেনাবাহিনী। তখন মানুষ কিন্তু সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ধরেছে, কান্না করেছে আবেগে। ফুল দিয়েছে, তাদের এপিসির (সাঁজোয়া যান) ওপর পতাকা নিয়ে গিয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় দ্বিতীয় দফায় বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। এর আগে ৯ অক্টোবর তিনি জবানবন্দি দেন। সেদিন জবানবন্দি অসমাপ্ত ছিল।
আসিফ মাহমুদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলেন। বৃহস্পতিবার জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর তাঁকে প্রথমে জেরা করেন এই মামলার আসামি ও শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেনের আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন। তিনি এক পর্যায়ে প্রশ্ন করেন, গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে আন্দোলন চলার সময় কোনো পুলিশ সদস্য আহত বা নিহত হয়েছেন কি না।
জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, তাঁর জানা নেই।
আইনজীবী বলেন, এক দফা কর্মসূচি (আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফা) ঘোষণার পেছনে বিদেশি ইন্ধন ছিল কি না।
এর জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, ছিল না।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনের অর্থের উৎস কী ছিল, তা নিয়েও আসিফ মাহমুদকে প্রশ্ন করা হয়।
এর জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, আন্দোলনকারীরাই আন্দোলনের খরচের জন্য ফান্ড (তহবিল) তৈরি করেছিলেন।
আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ কেউ ছিলেন কি না, এমন প্রশ্নও করা হয় আসিফ মাহমুদকে।
উত্তরে আসিফ মাহমুদ বলেন, আন্দোলনে কেউ প্রধান ছিলেন না। সমন্বয়কদের সবার মর্যাদা সমান ছিল।