ঘরে বসেই পণ্য বেচাকেনা

জীবন সহজ করছে অনলাইন কেনাকাটা

ঘরে বসেই পণ্য বেচাকেনা
ঘরে বসেই পণ্য বেচাকেনা

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন উত্তরার বাসিন্দা কামরুন নাহার। প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। অফিস শেষে বাসায় ফেরেন সন্ধ্যা সাতটায়। অফিস সময় আট ঘণ্টা, আর সাড়ে তিন ঘণ্টা কেটে যায় যানজটে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের পরিবারের দৈনন্দিন কাজ করেন, বাচ্চাদের সময় দেন। ব্যস্ততার কারণে সংসারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে সময় বের করতে পারেন না তিনি। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলেন, ঘরে বসে কীভাবে কেনাকেটা করবেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
বাসায় ফিরে কিছুটা সময় ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করা কামরুন নাহারের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। বছর খানেক আগে একদিন অনলাইনে ই-শপিংয়ের খোঁজ পান তিনি। প্রথম দিকে শুধু অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পোর্টালগুলোতে ঘোরাঘুরি করতেন। কোন পণ্যের দাম কত, মান কেমন, বিক্রেতা কোন এলাকার—এসব দেখতেন তিনি। মাস ছয়েক আগে একদিন সাহস করে একটি ওভেন কেনার জন্য বিক্রেতার মুঠোফোনে কল দেন। দামে বনে যাওয়ায় পরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ওই বিক্রেতার নির্ধারিত ঠিকানায় গিয়ে ওভেনটি কিনে আনেন। এভাবেই তিনি অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হলেন। গত ছয় মাসে তিনি একটি ওভেন ও বৈদ্যুতিক পাখা কিনেছেন।
কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনলাইন কেনাকাটা আমার জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। একটি জিনিস কিনতে আগে পুরো বিপণিবিতান ঘুরতে হতো। এতে অনেক সময় নষ্ট হতো।’
মিনহাজুল আবেদীন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। সিম্ফনি ব্র্যান্ডের একটি মুঠোফোন ব্যবহার করেন তিনি। এখন আরও দামি একটি মুঠোফোন কিনতে চান। তাই কয়েক দিন আগে একটি স্বনামধন্য ওয়েবপোর্টালে মুঠোফোনের তিনটি ছবি ও কাঙ্ক্ষিত দাম লিখে বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপন দেওয়ার এক দিনের মধ্যেই তিনি চার হাজার টাকায় মুঠোফোনটি বিক্রি করে দিলেন।
এভাবেই বাংলাদেশে এখন ক্রমশ অনলাইন বেচাকেনার প্রসার ঘটছে। অনলাইন বেচাকেনায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন ক্রেতারা। নগরজীবনের ব্যস্ততায় একটু স্বস্তি দিয়েছে এই অনলাইন বাণিজ্য। একটি মুঠোফোনই সহজ করে দিচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার জীবনাচরণ। মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
ক্রেতা-বিক্রেতার এই চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অনলাইনে বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমেও বেচাকেনা চলে। জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি থেকে শুরু করে হাঁড়িপাতিল, মাছ-মাংস পর্যন্ত বিক্রি হয় এসব ওয়েবপোর্টালে। এমনকি কোয়েল পাখির ডিমও বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে।
বিক্রয়ডটকম, সেলবাজার, ওএলএক্স, এখনিডটকম, আমার দেশ আমার গ্রাম ইশপ—এসব অনলাইন পোর্টাল এখন জনপ্রিয় হয়ে গেছে। অন্যদিকে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ওয়েবপোর্টালের মাধ্যমেও তাদের পণ্য বিক্রি করছে।
বাংলাদেশের ভোক্তা আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশিরা কী ধরনের ওয়েবপোর্টালে যেতে পছন্দ করেন—তার একটি চিত্র পাওয়া যায় গুগল ট্রেন্ডসের ২০১৩ সালের হিসাবে। সেখানে দেখানো হয়েছে, গুগল সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে এসএসসির ফলাফলের ওয়েবসাইটে সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশিরা। পরের স্থান রয়েছে এইচএসসি ফলাফলের ওয়েবসাইট। আর গুগল দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রবেশ করেছেন তৃতীয় সর্বাধিক ব্যক্তি। আশ্চর্যের বিষয় হলো, চতুর্থ স্থানটি দখল করে আছে অনলাইন বেচাকেনার ওয়েবপোর্টাল বিক্রয়ডটকম। এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফল জানতে বছরে এক দিনই সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা হয়। নিয়মিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিবেচনা আনলে ফেসবুকের পরেই বেচাকেনার ওয়েবপোর্টালে প্রবেশ করেন বাংলাদেশিরা।
সেলবাজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০১১ সালে প্রথম অনলাইনে বেচাকেনা শুরু করে। এরপরেই অনলাইন বেচাকেনার প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে এমন ২০ থেকে ২৫টি ওয়েবপোর্টাল রয়েছে। এ পোর্টালগুলো ব্যবসায়িকভাবে বেশ সফল হতে শুরু করেছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ এসব পোর্টাল দেখছে, এমন বিবেচনায় এখানে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনলাইন বেচাকেনা হয় দুইভাবে। সেলবাজার, বিক্রয়ডটকমের মতো ওয়েবপোর্টালে বিক্রেতা তাঁর পুরোনো পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। আগ্রহী ক্রেতা সেই বিজ্ঞাপন দেখে ওই বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে দুজনের আপসের ভিত্তিতে পণ্যটি বেচাকেনা হয়। এ জন্য অবশ্য নগদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব ওয়েবসাইটে এখন নতুন পণ্যের বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেওয়া শুরু হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাঁর নিজস্ব পণ্যের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।
আবার বেশ কিছু ওয়েবপোর্টাল রয়েছে, যারা নিজেরাই পণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে। ক্রেতা শুধু পণ্য পছন্দ করে অনলাইনে কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করেন।
বাংলাদেশে অনলাইনে বেচাকেনার সবচেয়ে বড় ওয়েবপোর্টাল হলো বিক্রয়ডটকম। ২০১২ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করে এ খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এটি। জানা গেছে, শুরুতে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার ক্রেতা পণ্য কিনতে এই ওয়েবপোর্টালে প্রবেশ করতেন। এখন প্রতি মাসে গড়ে ২০ লাখ আগ্রহী ক্রেতা নিয়মিতভাবে এই ওয়েবপোর্টালে যান। পোর্টালটিতে বর্তমানে তিন লাখের বেশি পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার বিজ্ঞাপন পায় বিক্রয়ডটকম। বিজ্ঞাপন দিতে কোনো পয়সা লাগে না। শুধু পণ্যের ছবি, দাম, বিক্রেতার যোগাযোগ নম্বর ও ঠিকানা দিতে হয়।
বিক্রয়ডটকমে প্রতিটি বিজ্ঞাপনের বিপরীতে চার-পাঁচটি ফোনকল পান বিক্রেতা। অনেক সময় বিজ্ঞাপন দেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই পণ্য বিক্রি হয়ে যায়।
বিক্রয়ডটকমের বিপণন ব্যবস্থাপক ইশিতা শারমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনলাইনে বেচাকেনা মানুষের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন করছে। আগে পুরোনো জিনিস ফেলে দেওয়া হতো কিংবা কাউকে উপহার দেওয়া হতো। এখন পুরোনো জিনিস বিক্রি করে সেই টাকা নতুন জিনিস কেনায় কাজে লাগানো হচ্ছে।’