পোশাকশিল্পে শ্রমিক কত?

দেশের রপ্তানি আয়কে বছরের পর বছর প্রায় এককভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। আর এ খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, গত তিন বছর ধরে এমন দাবিই করে আসছে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ আবার শ্রমিকসংখ্যা ৪২ লাখ বলেও দাবি করেন। যদিও এসব দাবির পেছনে কখনোই কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেননি তাঁরা।
পোশাক খাতে ঠিক কতজন শ্রমিক কাজ করেন কিংবা আসলেই ৪০ লাখ শ্রমিক আছেন কি না, সে বিষয়ে সরকারি কোনো সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই। দেশের তথ্য পরিসংখ্যানের জন্য গ্রহণযোগ্য সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছেও এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। সে জন্য সরকারও বিজিএমইএর এই তথ্যকে ভিত্তি করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে পোাশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের একটি নতুন তথ্য এখন মিলেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সম্প্রতি বলেছে, পোশাকশিল্পে ২১ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৭৯ এবং পুরুষ নয় লাখ ১৬ হাজার ১৮২ জন। রানা প্লাজা ধসের পর এক বছর ধরে সারা দেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে।
অবশ্য অধিদপ্তরের হিসাবের মধ্যে আনা হয়নি দেশের আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) অবস্থিত পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের। ইপিজেডের ১৮১টি পোশাক কারখানায় কর্মরত আছেন দুই লাখ ৫৯ হাজার ৫৭১ জন শ্রমিক। এর সঙ্গে অধিদপ্তরের শ্রমিকদের যোগ করলে পোশাকশিল্পে কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭২৫। এটি বিজিএমইএর দাবি করা শ্রমিকের সংখ্যার চেয়ে প্রায় ১৬ থেকে ১৮ লাখ কম।
অন্যদিকে বিবিএস দেশের উৎপাদন খাতের ওপর একটি জরিপ করেছে। এতে প্রাথমিকভাবে পোশাক খাতে ২৯ লাখ শ্রমিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে সংস্থার এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। তবে এই জরিপের তথ্য এখনো বিবিএস চূড়ান্ত করেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশও করেনি।
মূলত অধিদপ্তরের এই হিসাবের পরপরই প্রশ্ন উঠেছে, দেশের পোশাক খাতে আসলেই কি ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন? কোনটি সঠিক, পোশাকমালিকদের দেওয়া তথ্য, নাকি কলকারখানা অধিদপ্তরের তথ্যভান্ডার? এ বিষয়ে বিজিএমইএর নেতারা বলছেন, তাঁদের উল্লিখিত শ্রমিকসংখ্যা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। প্রত্যেক সদস্য কারখানার দেওয়া তালিকা অনুযায়ী তাঁরা শ্রমিকের এই হিসাবটি তৈরি করেছেন। আর কলকারখানা অধিদপ্তরের দাবি, তাদের পরিদর্শকেরা প্রত্যেকটি কারখানায় সংরক্ষিত রেজিস্ট্রার খাতা থেকেই শ্রমিকের সংখ্যাটি নিয়েছেন। এটি তাঁদের মনগড়া হিসাব নয়।
শ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে এই বিভ্রান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত সরকারকে প্রভাবিত করার জন্যই শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে বলার একটা প্রবণতা আছে মালিক সংগঠনের। পোশাকশিল্প খাতে ক্ষতি হলে অনেক লোক বেকার হবে, এমনটা বলে সরকারের কাছ থেকে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেয়।’
সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ আরও বলেন, ‘যথাযথ নীতিনির্ধারণের জন্য পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা জানা থাকা দরকার। এই শিল্পের জন্য সরকার যদি কোনো কল্যাণমূলক কাজ করতে চায়, সে জন্যও দরকার। তাই ভুয়া শ্রমিক অবশ্যই ক্ষতিকর।’

অধিদপ্তরের হিসাব: কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শকেরা দেশের তিন হাজার ৪৯৮টি কারখানা পরিদর্শন করে ২১ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকের অস্তিত্ব পান। পরিদর্শনের সময় ২১টি কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা জানতে পারেননি তাঁরা। আর বন্ধ পান নয়টি কারখানা। আর এসব তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পোশাক কারখানার একটি তথ্যভান্ডার তৈরি করে তা নিজেদের ওয়েবসাইটে (http://dife.gov.bd/) প্রকাশ করেছে অধিদপ্তর।
তবে অধিদপ্তরের এই হিসাবে আসেনি ইপিজেডের শ্রমিকেরা। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটটি ইপিজেডের ১৪০ কারখানায় কর্মরত ছিলেন দুই লাখ ২৭ হাজার ৮০০ শ্রমিক। এ ছাড়া নিট ও অন্যান্য টেক্সটাইলের ৪১ কারখানায় আছেন ৩১ হাজার ৭৭১। ফলে ইপিজেডে মোট শ্রমিক হচ্ছে দুই লাখ ৫৯ হাজার ৫৭১।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার এক হাজার ৫৫৫টি কারখানায় আট লাখ ৪৭ হাজার ২৮৩, গাজীপুরের ৮৯৪টি কারখানায় আট লাখ ছয় হাজার ৫৮৫, নারায়ণগঞ্জের ৫২৬টি কারখানায় দুই লাখ ১৫ হাজার ৭৩৪, চট্টগ্রামের ৪৭১টি কারখানায় দুই লাখ ৩১ হাজার ৫১১, ময়মনসিংহের ৩৪টি কারখানায় ১৬ হাজার ৭৭০, টাঙ্গাইলের ছয় কারখানায় তিন হাজার ৬১৪, কুমিল্লার তিন কারখানায় ৯৬০, মানিকগঞ্জের তিন কারখানায় ছয় হাজার ৭৮৭ এবং নরসিংদীর তিন কারখানায় ৯১০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
এসব তথ্যের সত্যতা কতটুকু?—জানতে চাইলে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মশিউর রহমান প্রথম আলোকে

বলেন, ‘অধিদপ্তরের পরিদর্শকেরা প্রতিটি পোশাক কারখানায় সংরক্ষিত নিবন্ধন খাতা থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন।’ বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জোট—অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এবং বুয়েট ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তিন হাজার ৬৭৯ পোশাক কারখানা পরিদর্শন করবে। এই তথ্য দিয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা তিন হাজার ৪৯৮টি কারখানার তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের পরিদর্শনের বাইরে খুব বেশি কারখানা নেই।’
অবশ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘অধিদপ্তরের সব পরিদর্শকই যে দক্ষ, তা নয়। ফলে ভুলত্রুটি কিছু হতে পারে। আবার কারখানা কর্তৃপক্ষও প্রকৃত তথ্য গোপন করে থাকতে পারে।’

বিজিএমইএ যা বলছে:
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে পোশাক কারখানায় শ্রমিক ছিল এক লাখ, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় চার লাখে। আর ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ১৩ লাখ। ২০০২-০৩ থেকে ২০০৪-০৫ অর্থবছর পর্যন্ত ছিল ২০ লাখ। তবে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এই শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লাখ। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে হয় ৪০ লাখ। বিজিএমইএর হিসাবে, এখন পর্যন্ত এটাই প্রকৃত শ্রমিকের সংখ্যা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মো. শহিদউল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, সমিতির তিন হাজার ৫৫১ সদস্য কারখানার শ্রমিকসংখ্যা প্রায় ৩৮ লাখ। এ ছাড়া বিকেএমইএর সদস্য কারখানার শ্রমিক হচ্ছে পাঁচ লাখ। তবে গত এক বছরে ১৭৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় এক লাখ শ্রমিক। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্পে বর্তমানে ৪২ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন।
অধিদপ্তরের দেওয়া শ্রমিকসংখ্যা বিষয়ে অবহিত করলে শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘অধিদপ্তরের এই তথ্য মনগড়া। মনে হচ্ছে, পরিদর্শকেরা কারখানায় না গিয়েই শ্রমিকদের এই সংখ্যা দিচ্ছেন।’ আসলে প্রকৃত শ্রমিকসংখ্যার ধারেকাছেও নেই অধিদপ্তরের হিসাব—এমনটাই দাবি তাঁর।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকসংখ্যা কম বা বেশি বলে বিজিএমইএর কোনো লাভ নেই। নিজেদের প্রয়োজনেই সংগঠনটির উচিত পোশাক কারখানার প্রকৃত শ্রমিকসংখ্যা সবাইকে জানান এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা। কারণ আন্তর্জাতিক মহল সব সময়ই শ্রমিকসংক্রান্ত বিষয়ে সোচ্চার৷ এ ক্ষেত্রে লুকোছাপা করলেই বিপদ৷’ তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত বিজিএমইএর মাধ্যমে শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন করা।

পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকের হিসাব নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি

হিসাব নিয়ে বিভ্রান্তি
পোশাক খাতে ঠিক কত শ্রমিক কাজ করেন সে বিষয়ে সরকারি কোনো সংস্থার কাছে গ্রহণযোগ্য তথ্য নেই। দেশের তথ্য পরিসংখ্যানের জন্য গ্রহণযোগ্য সংস্থা বিবিএসের কাছেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। সে জন্য সরকারও বিজিএমইএর তথ্যকে ভিত্তি করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়
বিজিএমইএ
৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন বলে সংগঠনটি তিন বছর ধরে দাবি করে আসছে৷ সংগঠনের নেতাদের কেউ কেউ আবার শ্রমিকসংখ্যা ৪২ লাখ বলেও দাবি করেন
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর
২১ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ শ্রমিক কাজ করেন ৩,৪৯৮টি কারখানায়৷ গত এক বছর ইপিজেডের বাইরের এই কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সংস্থাটি এই তথ্য পেয়েছেইপিজেডের ১৮১টি কারখানায় কর্মরত আছেন দুই লাখ ৫৯ হাজার ৫৭১ জন শ্রমিক। এর সঙ্গে অধিদপ্তরের প্রাপ্ত সংখ্যা যোগ করলে পোশাকশিল্পে মোট শ্রমিক দাঁড়ায়
২৩,৮৯,৭২৫