চার দশক ধরে গড়ে ওঠা রপ্তানি আয়ের শীর্ষ এই খাতটি যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে করোনা।

তরতর করে বেড়ে ওঠা তৈরি পোশাকশিল্পকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে করোনাভাইরাস। দুঃস্বপ্নের এই বছরে মালিকেরা ব্যবসার উল্টো পিঠ দেখে ফেললেন। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার সহায়তা দিলেও শ্রমিকেরা একের পর এক অমানবিক আচরণের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে চার দশক ধরে গড়ে ওঠা রপ্তানি আয়ের শীর্ষ এই খাতটি যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে করোনা।
পোশাক রপ্তানি নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত খারাপ করেনি বাংলাদেশ। চীনের হারানো ক্রয়াদেশের একটা অংশ উদ্যোক্তারা এ দেশে আনতে পেরেছেন। যদিও অনেক কারখানায় সক্ষমতার চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কম আছে। অন্যদিকে করোনার প্রথম ধাক্কা যখন সামলে ওঠার প্রত্যাশা করছিলেন, তখনই আবার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত। ফলে কঠিন সময় আরেকটু দীর্ঘ হবে। যদিও করোনার টিকা চলে আসছে।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনায় পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। বিদেশি ক্রেতাদের অপ্রত্যাশিত আচরণে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ার আতঙ্ক ঘিরে ধরে অনেককে। দ্রুততম সময়ে রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে পোশাক খাতের শ্রমিকদের তিন মাস মজুরি দেওয়ার জন্য প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরও মালিকেরা একের পর এক কারখানা লে-অফ ঘোষণা করেন। শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করেন।
মার্চে সাধারণ ছুটির কারণে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন করোনার সংক্রমণ প্রতিদিনই বাড়ছে। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ। এমন সময় মালিকদের নির্দেশে কর্মচারীরা শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেন। চাকরি বাঁচাতে শ্রমিকেরা ৪ এপ্রিল ট্রাকে চেপে, সিএনজি বা ভ্যানে চড়ে ও পায়ে হেঁটে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ঢাকায়। সেদিন সকাল থেকে মহাসড়ক, ফেরিঘাট ও বাসস্ট্যান্ডে শ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড় দেখে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আর ওই রাতেই কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন মালিকেরা। বাড়ি ফিরতে আবারও ভোগান্তিতে পড়েন শ্রমিকেরা।
করোনাকালে শ্রমিক ব্যবস্থাপনায় মালিকপক্ষের অদক্ষতা বারবার ফুটে ওঠে। সরকারের সহযোগিতার পরও নিজেদের লোকসান কমাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। এপ্রিলের তিন সপ্তাহ কারখানা বন্ধের অজুহাতে শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ মজুরি দিয়েছেন। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বারবার ছাঁটাই না করার অনুরোধ করলেও তা খুব একটা কানে তোলেনি মালিকপক্ষ। পরে ঈদ বোনাসও কম দেন তাঁরা। অন্যদিকে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হন শ্রমিকনেতারা। কিছু ক্ষেত্রে মালিকদের ইচ্ছামতো শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা কমাতে সহায়তাও করেছেন।
এদিকে যে ব্যবসা চলে যাওয়ার যতটা শঙ্কা শুরুতে ছিল, পরিস্থিতি ততটা খারাপ হয়নি। শুরুতে ৩১৮ কোটি ডলার সমপরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হলেও পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে নেন ক্রেতারা।
করোনার কারণে গত এপ্রিল ও মে যথাক্রমে ৩৭ ও ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। সেই প্রভাবে গত অর্থবছর পোশাক রপ্তানি ১৮ শতাংশ কমে যায়। জুন থেকে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১ হাজার ৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র দেড় শতাংশ কম।
করোনাকালে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন ব্যবসায়ীরা। শুরুতে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীন থেকে কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েন তাঁরা। পরে দুর্বল চুক্তির কারণে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি উদ্যোক্তারা।
বিপরীত চিত্রও আছে। করোনাকালে ওভেন পোশাকের রপ্তানি কমলেও বেড়েছে নিটের। এ ক্ষেত্রে দেশীয় উৎস থেকে কাঁচামাল প্রাপ্তির বিষয়টি বেশ কাজে দিয়েছে। তুলা আমদানি করতে হলেও নিটের অধিকাংশ কাপড়ই দেশে উৎপাদন হয়। আগামী দিনে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে কাঁচামাল, বিশেষ করে ওভেন কাপড় উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে হবে। পণ্য বহুমুখী করা ছাড়া রপ্তানি খুব বেশি বাড়ানো যাবে না।