মিসরের অর্থনীতি গত এক বছরে বড় ধরনের চাপে পড়েছে। দেশটির মুদ্রা পাউন্ড দাম হারাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
আরব বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটির অর্থনৈতিক সংকট কতটা গভীর, সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। দেখানো হয়েছে, মিসরের অর্থনীতির অবস্থা সত্যিকার অর্থে এখন কেমন রয়েছে।
কিছু কারণের পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যেমন শিল্পায়নে ব্যর্থতার ইতিহাস। দেশটির রপ্তানি নীতি ঠিকঠাকমতো কাজ করেনি। আর এসবের ফলে লম্বা সময় ধরে দেশটিতে বাণিজ্যঘাটতি চলছে।
স্থানীয় মুদ্রাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা, সম্পদের অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং মাথাভারী প্রশাসন ও বিশাল সেনাবাহিনী—এমন অনেক কিছুর কারণেই প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হয়নি, তৈরি হয়নি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশও। ভর্তুকি—যার পরিমাণ এখন কমানো হয়েছে—বাজেটের অর্থই কেবল পানিতে ফেলার কাজ করেছে।
তেল ও গ্যাস খাতের বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ সামান্যই পায় মিসর। ফলে অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে হচ্ছে প্রবাসী আয়, সুয়েজ খাল থেকে পাওয়া অর্থ এবং পর্যটনের মতো কর্মকাণ্ডকে।
দেশের এই খারাপ অবস্থার জন্য প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি অবশ্য প্রায়ই দায়ী করেন ২০১১ সালের আন্দোলন–পরবর্তী অস্থিরতা এবং জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিকে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে মিসরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
আর ২০২০ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ আরও দুটো কারণের কথা উল্লেখ করে—কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ।
তবে বিশ্লেষকেরা কিছু নীতিগত বিষয়ের কথা তুলে ধরেন। এসবের মধ্যে রয়েছে মিসরীয় পাউন্ডের দাম ধরে রাখার জন্য ব্যয়বহুল পদক্ষেপ, শেয়ারবাজারে অস্থির বিদেশি বিনিয়োগ এবং কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রমে ব্যর্থতা।
মিসরের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আছে। চলতি বছরে ৪ থেকে ৫ শতাংশের পূর্বাভাস রয়েছে। সমস্যা হলো এই প্রবৃদ্ধির সুফল মানুষ পাচ্ছে না জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে। অনেক মিসরীয় বলেন যে তাঁদের জীবনযাত্রার মান কেবল খারাপই হচ্ছে।
গত এক বছরে মিসরীয় পাউন্ড মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৫০ শতাংশ দাম হারিয়েছে। ডলারের বড় ধরনের সংকট আমদানিকে কঠিন করে তুলেছে। অনেক পণ্য বন্দরে পড়ে রয়েছে, যার আবার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় শিল্পের ওপর।
বার্ষিক মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ছিল ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম দ্রুত বাড়ছে।
সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানে বলা হয়েছিল যে কোভিড মহামারির আগে জনগোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ ছিল দরিদ্র মানুষ। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই হার এরপর আরও বেড়েছে। মিসরের ১০ কোটি ৪০ লাখ মানুষের ৬০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে কিংবা এই সীমার কাছাকাছি বাস করে বলে ধারণা করা হয়।
বেকারত্বের হার কমে ৭ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু শ্রমবাজারে মানুষের অংশগ্রহণ ২০২০-এর দশকে কমছে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অংশ ধসে পড়ার মুখে রয়েছে। স্নাতকদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে যেতে এক পায়ে খাড়া রয়েছে।
পশ্চিমা ও উপসাগরীয় দেশগুলো একটি উত্তাল অঞ্চলে সিসির শাসনাধীন মিসরকে নিরাপত্তার একটি অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করে।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মিসরের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ার পর কায়রো বিভিন্ন উপসাগরীয় মিত্রদেশ বিশেষ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে শত শত কোটি ডলার তহবিল পেয়েছে।
উপসাগরীয় দেশগুলো আগেই দেওয়া তহবিল নতুন করে বিনিয়োগ করছে। তবে নতুনভাবে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা শর্তগুলো কঠিন করেছে। এসব বিনিয়োগের ফলাফল আসুক, এটাই তারা আরও বেশি করে চাইছে।
২০২২ সালের মার্চে সরকার জানায় যে নতুন ঋণের জন্য তারা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত আইএমএফ মিসরকে ৩০০ কোটি ডলারের তহবিল জোগাতে রাজি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়েছে যে অর্থনীতিতে রাষ্ট্র এবং সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কমাতে হবে।
মিসরের ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। তবে বিশ্লেষকেরা ঠিক একমত নন যে এই ঋণ কতটা ঝুঁকি তৈরি করছে।
সরকারের পূর্বাভাস বলেছ, জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির ৯৩ শতাংশে। কয়েক বছর ধরে এই হার বাড়ছে। তবে সরকারের লক্ষ্য, ২০২৬ সালে এটি কমিয়ে ৭৫ শতাংশে নামিয়ে আনা।
ঋণের বোঝা, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা সুদের হার এবং দুর্বল মুদ্রার কারণে ঋণ পরিশোধে সরকারের খরচ বাড়ছে। জুনে শেষ হওয়া বছরে আদায় করা রাজস্বের ৪৫ শতাংশ কেবল ঋণের সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে বলে পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে।
বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের কারণে বৈদেশিক তহবিলে ঘাটতি বাড়ছে। আগামী তিন বছরে মিসরকে অবশ্যই আইএমএফকে ১ হাজার ১৪০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের মতো নিয়মিত খরচের বাইরে সিসির শাসনাধীনে থাকা মিসর অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে।
এসবের মধ্যে রয়েছে গৃহ নির্মাণ, নতুন শহর গড়ে তোলা ও একের পর এক সড়ক তৈরি। সবচেয়ে বড় মেগা প্রজেক্ট হলো কায়রোর পূর্ব দিকে মরুভূমির মধ্যে একটি নতুন রাজধানী শহর নির্মাণ। একজন কর্মকর্তা বলছেন, শহর নির্মাণে ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের খরচ জোগাতে ভূমিও বিক্রি করা হচ্ছে।
গত এক দশকে মিসরের অস্ত্র আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, অস্ত্র আমদানিকারকদের তালিকায় মিসর তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা গরিবদের জন্য সামাজিক খাতে খরচ বাড়িয়েছেন। এর মধ্যে একটি হলো ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সাহায্য দেওয়া। তবে সমালোচকেরা বলছেন, জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে এই সাহায্য খুব একটা কাজে আসছে না।