মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ
মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ

মূলধন বাড়াতে বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে ইউসিবি

বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ৪২ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী শনিবার। গত আগস্টে সরকার বদলের পর ব্যাংকটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।

প্রশ্ন

কী উদ্দেশ্য নিয়ে ইউসিবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে।

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: ইউসিবি হচ্ছে দেশের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক। ১৯৮৩ সালের ২৮ জুন ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করেছিল। স্বাধীনতার ১২ বছর পর একসঙ্গে ইউসিবিসহ কয়েকটা বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন পায়। তখন অর্থনীতি বড় হতে শুরু করে, কিন্তু অর্থায়ন করার মতো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য কুক্ষিগত ছিল কিছু পাকিস্তানি পরিবারের হাতে। এখন যাদের বড়-মাঝারি শিল্পগ্রুপ হিসেবে দেখা যায়, তাদের বেশির ভাগের যাত্রা শুরু হয় দেশে বেসরকারি ব্যাংক চালুর পর। ফলে দেশের শীর্ষ করপোরেটরা ইউসিবির গ্রাহক। ব্যাংকের উদ্দেশ্যই ছিল বেসরকারি খাতকে এগিয়ে নেওয়া। সেটা সফল হয়েছে। আমাদের ৬১ হাজার কোটি টাকার ঋণের ৭০ শতাংশই বেসরকারি খাতের করপোরেট উদ্যোক্তারা নিয়েছেন। যারা দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অবদান রেখে চলছে।

প্রশ্ন

গত ৪২ বছরে ইউসিবি কতটা বড় হয়েছে। কোন খাতে ঋণ কেমন আপনাদের?

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: ৪২ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, আমাদের আমানত ৬১ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। আমাদের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকার তহবিল ব্যবস্থাপনা করছি আমরা। ফলে আমানত ও ঋণ—দুইভাবেই ইউসিবি বড় ব্যাংক। দেশের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের একটি ইউসিবি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭ শতাংশ আমাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার কথা যদি বলা হয়, তাহলে পোশাক খাত থাকবেই। পোশাক খাতে অর্থায়নে শীর্ষ ব্যাংক ইউসিবি। পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে উঠেছে। যেখানে আমাদের অর্থায়ন আছে। আমাদের ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ হচ্ছে মাঝারি করপোরেট ও বড় করপোরেটদের। বাকি ৩০ শতাংশ ঋণ গেছে ভোক্তা, সিএমএসএমই, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে। সারা দেশে আমাদের ২৩১ শাখা, ১৮১ উপশাখা ও ৬৪৫টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে। আমাদের আমানত গ্রাহক রয়েছে ২৪ লাখ ৬২ হাজার। ব্যাংকের নিয়মিত কর্মী রয়েছেন ৫ হাজার ৭৮৯ জন।

প্রশ্ন

সাড়ে তিন বছরে ডলার ৮৫ থেকে ১২৩ টাকায় উঠেছে। সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪-১৫ শতাংশে উঠেছে। পাশাপাশি আপনাদের ব্যাংকেও পরিবর্তন এল। কেমন করছেন গ্রাহকেরা।

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পর সুদহার বাড়তে শুরু করে। তখন আমানতের সুদ ১৪ শতাংশে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুদ ১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত সুদহার বাজারভিত্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ছিল। ২০২০ সালে ছয়-নয় সুদহার এল। ৬ শতাংশ আমানতের সুদ অবশ্য আনুষ্ঠানিক করা হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালে ডলারের চাপ তৈরি হলো। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করল। এতে বাজারের তারল্যের বড় অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপরই সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার পর তা বাড়তে শুরু করল। ফলে সবাই চাপে পড়ে গেছে। ডলারের মূল্য ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি—এত চাপ নেওয়ার মতে সক্ষমতা দেশের খুব কম ব্যবসায়ীর রয়েছে। এ ছাড়া সব খাত এত মুনাফাও করে না। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ২৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে ঋণের অপব্যবহার, অনিয়মও ছিল। আমাদেরও খেলাপি ঋণ ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে। আমাদের করপোরেট গ্রাহকদের কিছু ভালো করছে, কিছু ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। করোনার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিসহায়তার পাশাপাশি অর্থসহায়তাও দিয়েছিল। তখন ব্যবসায়ীরা সংকটে পড়েও ঘুরে দাঁড়ান। এখন আবার নতুন করে সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একটি কমিটি কাজ করছে। আশা করছি, এবারও সবাই ঘুরে দাঁড়াবে। এর বাইরে ছোট ও মাঝারি গ্রাহকেরা ভালো অবস্থানে আছেন।

প্রশ্ন

আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকে কী পরিবর্তন এল। কী কৌশলে এগোচ্ছেন। লক্ষ্য কী আপনাদের।

মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদ: আমাদের নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেয় গত ২৭ আগস্ট, আমি যোগ দিই ৩০ সেপ্টেম্বর। ব্যাংকে যে কারণে পরিবর্তন এসেছে, সেটা প্রকাশ হওয়ার পর আমাদের কিছু করপোরেট গ্রাহক আমানত তুলে নেয়। একই সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যখন আমি দায়িত্ব নিই, তখন চাহিদামতো নগদ জমা রাখতে পারছিলাম না। তবে কোনো গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়েননি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হয়নি। আমি যোগদানের পর আমানত সংগ্রহ করাটা ছিল অন্যতম প্রধান কাজ। সেটা আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি। অন্য ব্যাংকের চেয়ে কম সুদ দিয়েও আমরা চলতি বছর ৬ হাজার ২১৮ কোটি টাকা আমানত পেয়েছি। যেখানে ২০২৪ সালের পুরো বছরে আমানত এসেছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। এ বছরের টার্গেট ১২ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করা। আমাদের সময়ে ব্যাংকে ৩ লাখ নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে এনে নতুন গ্রাহক যুক্ত করতে পেরেছি আমরা। এর মধ্যে চারটা বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের ক্রেডিট লাইন চালু হয়েছে।

আমাদের আরেকটা কাজ ছিল কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। আমরা তাদের বলছিলাম ব্যাংকের স্বাস্থ্য এমন কোনো খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়নি যে তাদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। পাশাপাশি আমরা কৌশল ঠিক করলাম পরবর্তী তিন-পাঁচ বছর কী করব। আমাদের ব্যাংকে সুশাসনের সর্বোত্তম চর্চা করা হবে। সামনে আমাদের এসএমই, ভোক্তাঋণ যতটা বাড়ছে, করপোরেট ঋণ ততটা বাড়বে না। আমরা মূলধন দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নিয়েছি। রাইট শেয়ার এবং নতুন শেয়ার দুটিই ছাড়তে চাই আমরা। এখন বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে ইউসিবি। যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, এমন কাজে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান খোঁজা হচ্ছে।

সামনে আমরা আরও ডিজিটাল যাত্রা করতে চাই। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা ভোক্তা ও এসএমই ব্যাংকিংয়ের পুরোটাই ডিজিটাল করে ফেলতে চাই। আমাদের ব্যাংকের চারটা লাইসেন্স আছে। ফলে সব ধরনের সেবার সঙ্গে আমরা যুক্ত হতে পারব। ঘরে বসে ব্যাংকিং করতে আমরা সব ধরনের উদ্যোগ নেব। ব্যাংকিং রোবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার শুরু হয়েছে। আমরা এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে চাই।