
১৯৯২ সালে বহুজাতিক ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনালের (বিসিসিআই) বাংলাদেশ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেই কার্যক্রম পুনর্গঠনের মাধ্যমে সরকারের উদ্যোগে ইস্টার্ন ব্যাংক গঠিত হয়। নবগঠিত ব্যাংকটির মূলধনের ৬০ শতাংশ দেয় সরকার। বাকি মূলধনের সমমূল্যের শেয়ার দেওয়া হয় বড় আমানতকারীদের। বর্তমানে ইস্টার্ন ব্যাংক দেশের শীর্ষ মডেল ব্যাংকগুলোর একটি।
প্রায় ৩৩ বছর পর একই আদলে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে নতুন আরেক ব্যাংক গঠনের স্কিম বা নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকটে পড়া পাঁচ ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে এই ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন ব্যাংকটির লোগোও উন্মোচন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে নতুন ব্যাংক গঠনের স্কিম সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছে। এতে নতুন ব্যাংকের মূলধন ও পাঁচ ব্যাংকে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট করা হয়েছে।
এ উদ্যোগের ফলে সংকটে পড়া পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামনে থেকে দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা দূর হতে চলেছে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও ভালো পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংককে একটি ভালো ব্যাংক হিসেবে গড়ে তোলা হবে বলে আশা করছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠিত হচ্ছে, সেগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংক। পাঁচ ব্যাংকের দায়, সম্পদ ও জনবল অধিগ্রহণ করবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক। এরপর ধীরে ধীরে পাঁচ ব্যাংক বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারলে টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। নতুন আমানত এলে ব্যাংকটি দাঁড়িয়ে যাবে। এ জন্য শুরু থেকেই সুশাসনে জোর দিতে হবে। একটি ভালো পরিচালনা পর্ষদ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনাই ব্যাংকটিকে সফল করে তুলতে পারে।—আনিস এ খান, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি।
পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন। বাকি চারটি ব্যাংক ছিল চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তাঁরা দুজনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এসব ব্যাংকে নামে–বেনামে তাঁদের শেয়ার ছিল এবং তাঁরা ঋণের সুবিধাভোগী ছিলেন। এ কারণে ব্যাংকগুলোর সব শেয়ার শূন্য করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক খাত ও ছোট আমানতকারীদের স্বার্থে উদ্যোগটি ভালো হয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো বাজেট থেকে কত টাকা জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। কারণ, রাজস্ব আয়ের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয়। তবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারলে টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। নতুন আমানত এলে ব্যাংকটি দাঁড়িয়ে যাবে। এ জন্য শুরু থেকেই সুশাসনে জোর দিতে হবে। একটি ভালো পরিচালনা পর্ষদ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনাই ব্যাংকটিকে সফল করে তুলতে পারে।’
স্কিম অনুযায়ী, পাঁচ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে একটি ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার ইতিমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন দিয়েছে, যা রেজল্যুশন স্কিমে ‘ক’ শ্রেণির শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হবে।
পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়ী আমানতের অংশ থেকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারে রূপান্তরিত হবে, যা ‘খ’ শ্রেণির শেয়ার হিসেবে গণ্য হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের স্থায়ী আমানতের অংশ থেকেও সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা শেয়ারে রূপান্তরিত হবে, যা ‘গ’ শ্রেণির শেয়ার হিসেবে বিবেচিত হবে।
স্কিমে বলা হয়েছে, পাঁচ ব্যাংকের দায়, সম্পদ ও জনবল অধিগ্রহণ করবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় হবে ঢাকায়। ইতিমধ্যে রাজধানীর মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনে প্রধান কার্যালয় খোলা হয়েছে। এর আগে পাঁচ ব্যাংকের সব শেয়ার শূন্য ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি, জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি, বহুজাতিক কোম্পানি, রেজল্যুশনের আওতাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশি দূতাবাসগুলোর ক্ষেত্রে এই শেয়ার রূপান্তরের বিধান প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের আমানত শেয়ারে রূপান্তর করা যাবে না। এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
নতুন ব্যাংক পরিচালনার জন্য প্রাথমিকভাবে সাত সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। এর মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ সদস্যকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
স্কিমে পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের আমানত ফেরত দেওয়ার সময়সূচিসহ সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, সব আমানতকারীর অর্থ নিরাপদ রয়েছে।
স্কিম অনুযায়ী, যেসব সাধারণ গ্রাহকের আমানত দুই লাখ টাকা পর্যন্ত, তাঁদের অর্থ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে এবং ‘আমানত সুরক্ষা আইন’-এর আওতায় যেকোনো সময় উত্তোলন করা যাবে। যাঁদের আমানত দুই লাখ টাকার বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে অর্থ কিস্তিতে উত্তোলনের সুযোগ থাকবে। চলতি ও সঞ্চয়ী আমানত নির্ধারিত মেয়াদ অনুযায়ী তোলা যাবে, পুরো অর্থ তুলতে সর্বোচ্চ ২৪ মাস সময় লাগবে।
গুরুতর রোগে আক্রান্ত, যেমন ক্যানসার বা কিডনি ডায়ালাইসিসে আক্রান্ত আমানতকারীদের জন্য মানবিক বিবেচনায় বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। তাঁরা চিকিৎসার প্রয়োজনে নির্ধারিত সময়সীমা বা সীমার বাইরে গিয়েও অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন।
স্কিমে বলা হয়েছে, দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত একীভূতকরণ কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে যেকোনো সময় উত্তোলনযোগ্য। দুই লাখ টাকার বেশি আমানতের ক্ষেত্রে প্রথম এক লাখ টাকা স্কিম কার্যকরের তিন মাস পর তোলা যাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ৬, ৯, ১২, ১৫, ১৮ ও ২১ মাস পর এক লাখ টাকা করে উত্তোলন করা যাবে। বাকি অর্থ ২৪ মাস পর উত্তোলন করা যাবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের ক্ষেত্রেও একই সময়সূচি প্রযোজ্য হবে।
মেয়াদি ও স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা ঋণসুবিধা নেওয়া যাবে। বিভিন্ন মেয়াদের স্থায়ী আমানত নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন বা দীর্ঘ মেয়াদে রূপান্তর করা হবে। চার বছরের বেশি মেয়াদি আমানত মেয়াদ পূর্তির পর পরিশোধযোগ্য হবে।
স্কিম অনুযায়ী, হস্তান্তরকারী পাঁচ ব্যাংকে কর্মরত যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা বিভাগীয় অভিযোগ নেই, তাঁরা নির্ধারিত দিনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের কর্মী হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে তাঁদের চাকরির শর্ত পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা থাকবে নতুন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে।
শর্ত পরিবর্তনের ফলে যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন-ভাতা বা অন্যান্য সুবিধা কমে যায়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা আইনি বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো আপত্তি তুলতে পারবেন না। কেউ নতুন ব্যাংকে কাজ করতে অনিচ্ছুক হলে তাঁকে সেটি লিখিতভাবে জানাতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিনি নতুন ব্যাংকের কর্মচারী হিসেবে গণ্য হবেন না।
এ ছাড়া নতুন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যদি প্রয়োজন মনে করে বা কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতারণামূলক কিংবা চাকরিবিধি পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পায়, তাহলে কারণ দর্শানো ছাড়াই তাঁকে বরখাস্ত করতে পারবে।
স্কিমে আরও বলা হয়েছে, হস্তান্তরকারী ব্যাংকের আমানতকারী ও পাওনাদারদের স্বার্থে গৃহীত রেজল্যুশন স্কিমের কোনো কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। স্কিমের কোনো বিধানের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।