কেন্দ্রীয় ব্যাংক এস আলমের চার ব্যাংকের সঙ্গে এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করতে চায়।

এস আলমের লুটপাটে সংকটে পড়া চার ব্যাংকের সঙ্গে এক্সিম ব্যাংকের একীভূত করার উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ ওই চার ব্যাংকের চেয়ে এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে যে বাকি চারটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহকেরাও অনিশ্চয়তায় পড়বেন। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে পারেন অনেক গ্রাহক।
এ ছাড়া এক্সিম ব্যাংকের উদ্যোক্তা–পরিচালক ও শেয়ারধারীদের কোনো ধরনের মতামত ছাড়াই সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাংকটিকে একীভূত করার উদ্যোগ কতটা কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে। এর আগে বিগত সরকারও আর্থিক অনিয়মে ধুকতে বসা কিছু ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনেকটা ভালো ব্যাংকগুলোর ওপর খারাপ ব্যাংকের দায় চাপিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। ফলে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে ভালো ব্যাংকের একীভূত হওয়ার উদ্যোগটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে সরকার বদলের পর সেই উদ্যোগও বাদ হয়ে যায়। তার বদলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ইসলামি ধারার ৫ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একীভূত করার সিদ্ধান্তটি এসেছে সরকারের তরফ থেকে। এ কারণে এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার এক্সিম ব্যাংকের বর্তমান পর্ষদও এই একীভূতকরণের উদ্যোগে রাজি নয়। তারা বলছে, সংকট কাটিয়ে এক্সিম ব্যাংক ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি চারটির নিয়ন্ত্রণ এত দিন এস আলম গ্রুপের হাতে ছিল। সরকার এই পাঁচটি ব্যাংককে একত্র করে নতুন একটি ব্যাংক করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শুরুতে নতুন এই ব্যাংকে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান দেবে সরকার। পাঁচটি ব্যাংক মিলে এক হওয়া ব্যাংকটির প্রধান কাজ হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে (এসএমই) অর্থায়ন করা। এই ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সেই ব্যাংকের অধীনে পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ স্থানান্তর করা হবে। চলতি মাসের শুরুতে শরিয়াহ্ভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক মিলে একটি বড় ইসলামি ধারার ব্যাংক গঠনের লক্ষ্যে সভা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন,বিশেষ নিরীক্ষার পর ব্যাংকটির সঙ্গে একীভূত করার আলোচনা করা হয়েছে। তবে এখনো একীভূত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। একীভূত হওয়ার মতো পরিস্থিতি না হলে বা কেউ ইচ্ছুক না হলে একীভূত করা হবে না। সবার সঙ্গে পরামর্শ করেই এই প্রক্রিয়া বস্তাবয়ন করা হবে। আমানতকারীদের স্বার্থেই সবকিছু করা হবে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে কাটিয়ে উঠতে বহুদিন সময় লেগে যাবে। এ জন্য একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো দেশের অনেক মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে। প্রক্রিয়া মেনে একীভূত করা হলে দেশের একটি বড় শরিয়াহ ব্যাংক গড়ে উঠবে।’
এদিকে একীভূত হওয়া পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে এস আলমের চার ব্যাংকের তুলনায় আর্থিক নানা সূচকে এক্সিম ব্যাংক ভালো অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকটির পর্ষদ ও শেয়ারধারীরা ওই চার ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে আগ্রহী নয়। এক্সিম ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্য চার ব্যাংক এখনো আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের যে ব্যবসা করে, তার চেয়ে একাই বেশি ব্যবসা করছে এক্সিম ব্যাংক। দেশের রপ্তানি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অনেকে এখনো এক্সিম ব্যাংকের গ্রাহক।
এক্সিম ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি আয় আহরণকারী ব্যাংকের একটি। সরকার বদলের পর এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও টাকা তুলতে গিয়ে কোনো গ্রাহক সমস্যায় পড়েননি। গত ৯ মাসে ব্যাংকটির গ্রাহকেরা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন। এসব অর্থ তুলে নিতে গ্রাহকদের কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এ ছাড়া খেলাপি ঋণে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায়ও এক্সিম ব্যাংক নেই। অন্য অনেক ব্যাংক মূলধঘাটতিতে পড়লেও এক্সিম ব্যাংকের মূলধনঘাটতি নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব বিবেচনায় পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার কোনোটিতেই এক্সিম ব্যাংক পড়ে না।
জানা যায়, ২০২৪ সালে এক্সিম ব্যাংক আমদানি-রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে ৫০ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার ব্যবসা করে। আর চলতি বছরে মে মাস পর্যন্ত ব্যবসা করেছে ১৮ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা বাকি চার ব্যাংকের চেয়ে বেশি। গত ১০ মাসে এক্সিম ব্যাংকে ২ লাখ ৯৪ হাজার নতুন হিসাব খোলা হয়েছে। এ সময়ে নতুন আমানত এসেছে ১০ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এ সময় ঋণ আদায় হয়েছে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সারা দেশে এক্সিম ব্যাংকের ১৫৫ শাখা ও ৭৪টি উপ-শাখা রয়েছে। ব্যাংকে কর্মরত রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৩ কর্মী। ব্যাংকটির মোট গ্রাহকের সংখ্যা ১৬ লাখ ৬৪ হাজার। গত মে মাস শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকায়, ঋণ বা বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানান, অন্য চার ব্যাংকের মালিকানা এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই চার ব্যাংকে সবার চোখের সামনে লুটপাট করা হয়েছে, ফলে ব্যাংকগুলো পটপরিবর্তনের পর বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। কিন্তু এক্সিম ব্যাংকের অবস্থা তেমন নয়। এক্সিম ব্যাংক একীভূত হবে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ঘোষণা দিলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাতে এক্সিম ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোও সহজ হবে। বরং এখন একীভূত করার ঘোষণায় নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এক্সিম ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৯৪ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৬ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯২ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২ শতাংশ। সেখানে এক্সিম ব্যাংকের খেলাপির ঋণের হার ২৮ শতাংশ। পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার গত মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা ও ক্ষমতা—দুটোই রয়েছে। তবে এটা স্বেচ্ছায় হওয়া উচিত। সারা বিশ্বে ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশেও নিয়ম মেনে ব্যাংক একীভূত করা হলে ভালো হবে।’
ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মু. ফরীদ উদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক পাঁচটি নিজে চলতে পারছে না, তাই একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে একীভূত করাটা ভালো উদ্যোগ।’
এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর এক্সিম ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। এর পর থেকে ব্যাংকটি পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। আগে যেসব ঋণের সমস্যা ছিল, সেগুলোর বিষয়ে নিয়ম অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় এক্সিম ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ নিলে সেটা ভালো উদাহরণ হবে না। এতে অনেক ভালো ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের অনাস্থা তৈরি হতে পারে। কারণ, ভবিষ্যতে অনেক ব্যাংকের পরিণতি একই হতে পারে।
১৯৯৯ সালে সালে প্রতিষ্ঠিত এক্সিম ব্যাংকে ২০০৭ সাল থেকে চেয়ারম্যান পদে ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। একই সঙ্গে তিনি প্রায় দেড় দশক ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান ছিলেন। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন। এ ছাড়া শেয়ারধারীদের মধ্য থেকে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মো. নুরুল আমিন ও অঞ্জন কুমার সাহা। স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এস এম রেজাউল করিম ও সনদধারী হিসাববিদ খন্দকার মামুন।
জানতে চাইলে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিবেচনায় পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে এক্সিম ব্যাংক পড়ে না। একীভূত করার ঘোষণার কারণে আমাদের গ্রাহকেরা আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন, যা পুরো ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। আমাদের একীভূত করা হবে না, এই ঘোষণা দিলেই এক্সিম ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললে আগামী বছরে নতুন রূপে ফিরবে এক্সিম ব্যাংক।’