নির্বাচনের ঠিক আগে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে সরকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়েছে। তবে এসব অবকাঠামো প্রকল্প যেন শুধু দেখার বিষয় না হয়ে মানুষ ব্যবহার করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন যে রাজনীতিবিদদের মধ্যে ‘লোক দেখানোর’ প্রবণতা থাকে, সুতরাং এসব প্রকল্প যেন ‘তাজমহল’ হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে চায় সরকার। এ জন্য সংশোধিত এডিপিতে বড় বড় প্রকল্পে বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প বরাদ্দ কমানো হলেও শীর্ষ ১০ প্রকল্পে খুব বেশি কাঁচি পড়েনি।
সংশোধিত এডিপিতে শীর্ষ ১০ প্রকল্পে সব মিলিয়ে বরাদ্দ পেয়েছে ৫০ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এই ১০টি প্রকল্পের মধ্যে চারটির বরাদ্দ মূল এডিপি থেকে বাড়ানো হয়েছে। বাকি ছয়টিতে বরাদ্দ অল্প কিছু কমেছে। জনতুষ্টি অর্জন করে, এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র, সড়ক-সেতু, মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প গুরুত্ব পেয়েছে।
প্রকল্পগুলো হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪), পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ), ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প (মেট্রোরেল), সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প (এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প।
মেট্রোরেল চালু হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেট্রোরেলে ‘রাইড’ হিসেবে চড়েন মানুষ। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ‘তাজমহল’ নয়, যা মানুষ দেখতে যাবে। মানুষকে এসব অবকাঠামো ব্যবহার করতে হবে। এতেই বিনিয়োগ উঠে আসবেমুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব
সংশোধিত এডিপির ২৩ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে ওই ১০টি প্রকল্প। গত বুধবার ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার এই সংশোধিত এডিপি পাস করা হয়। এতে মূল এডিপি থেকে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তবে শীর্ষ ১০ প্রকল্প থেকে কমেছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনীতিবিদদের মধ্যে ‘লোক দেখানো’ উন্নয়ন প্রকল্প করার প্রবণতা আছে। তাঁরা মনে করেন, এতেই তাঁরা বেশি জনপ্রিয় হবেন। তাই অর্থনীতির এই চাপের সময়েও নির্বাচনের বছরে এসব বড় প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এই বিষয়ে দুটি উদাহরণ দেন।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বিশাল এক্সপ্রেসওয়ে বানিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের উন্নয়নকে দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই এক্সপ্রেসওয়ে সাধারণ মানুষ ব্যবহার না করে পাশের সাধারণ সড়ক ব্যবহার করেন। আমাদের এখানে মেট্রোরেল চালু হলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেট্রোরেলে “রাইড” হিসেবে চড়েন মানুষ। অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প “তাজমহল” নয়, যা মানুষ দেখতে যাবে। মানুষকে এসব অবকাঠামো ব্যবহার করতে হবে। এতেই বিনিয়োগ উঠে আসবে।’
দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের জন্য চলতি বছরের মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ১১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে একক প্রকল্প হিসেবে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা সংশোধিত এডিপির প্রায় ৫ শতাংশ।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। এটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৫২ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এবারে মূল এডিপি থেকে সাড়ে আট শ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ পেয়েছে এই প্রকল্পটি। বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৪৯০ কোটি টাকায়। গত আট বছরে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে।
চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) মোট খরচ ৩৮ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু এখন তা কমিয়ে ৬ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী জুন মাসে কর্মসূচিটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হবে না।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটির মাধ্যমে দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ তৈরি করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৪ সালের জুন মাসে। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে আরও এক শ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দেড় বছরে বাকি কাজ শেষ করতে হবে।
সরকারের অগ্রাধিকারের আরেক প্রকল্প হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ (১ম পর্যায়) বা তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ৬ হাজার ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৪ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে টার্মিনালটি উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের খরচ ১৬ হাজার ৯০১ কোটি, যার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
রাজধানীর যানজট কমাতে এবং যাত্রীদের দ্রুত চলাচলের জন্য ২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর এবং ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। গত ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। ২০২৪ সালে জুন মাসের মধ্যে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর অংশ নির্মাণের মাধ্যমে মেট্রোরেল প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এই প্রকল্পের জন্য এক দফা খরচ বাড়িয়ে এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেই যাতে প্রকল্পটির বেশির ভাগ কাজ শেষ হতে পারে, সে জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। নির্বাচনের আগে সড়ক নির্মাণের এই প্রকল্পটি আরও দৃশ্যমান করতে চায় ক্ষমতাসীন সরকার। সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে।
যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপি থেকে আড়াই শ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এখন বরাদ্দ হলো ২ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে।
ভোট টানতে মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ একটি জনপ্রিয় উপায় হিসেবে বিবেচিত। নির্বাচনের আগের বছরে জেলা ও উপজেলায় মসজিদ নির্মাণের প্রকল্পে সরকার আরও গতি বাড়াতে চায়। তাই বরাদ্দপ্রাপ্ত শীর্ষ ১০ প্রকল্পে ঢুকে পড়েছে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা।