
বাংলাদেশ মুদ্রা বিনিময় হার নমনীয় করবে কি না, তার ওপর নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণের কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি। নমনীয় করার অর্থ হচ্ছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার মান কত হবে, তা ঠিক হবে বাজারে। তবে বাংলাদেশ এখনই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে চায় না। এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে গতকাল সোমবার অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল বৈঠকে সমঝোতা হয়নি।
আইএমএফের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় প্রায় দেড় ঘণ্টার ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশের দিক থেকে নেতৃত্ব দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান ও কবির আহমেদ ছিলেন।
বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
তবে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি, আবার আলোচনার পথও বন্ধ হয়ে যায়নি। সমঝোতার বিষয়ে আরও বৈঠক হবে। আইএমএফকে জানানো হয়েছে এবং বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই নয়।
বাংলাদেশে বাজার ভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালুর বিষয়টি আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির শর্তেও ছিল। গত মাসে আইএমএফের ‘ঢাকা মিশন’, অর্থাৎ কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরে এ নিয়ে আলোচনা ও দর-কষাকষি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনেও গত মাসে এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখনো সমঝোতা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হলে মুদ্রা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানি পণ্যের দাম আরও বাড়বে। দেশে যেখানে এমনিতেই মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি, তা আরও বেড়ে যেতে পারে।
বৈঠকে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির বাইরে আইএমএফের কাছে আরও ১০০ কোটি ডলারের একটি স্থিতিশীলতা তহবিল (স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড) চাওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের দিক থেকে যুক্তি হচ্ছে, বিনিময় হার নমনীয় করলে সম্ভাব্য যেসব সমস্যা হতে পারে, তা মোকাবিলা করা হবে এ তহবিলের অর্থে। অর্থাৎ, ডলারের দাম বাড়তে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই তহবিল থেকে মুদ্রা সরবরাহ করে বাজার স্থিতিশীল করবে, যাতে রিজার্ভে হাত না দিতে হয়। কিন্তু আইএমএফ এতে গতকাল পর্যন্ত রাজি হয়নি।
সরকারের দিক থেকে ঋণ কর্মসূচিটি চলমান রাখার চেষ্টা আছে বলে জানা গেছে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যার সার কথা হচ্ছে কঠিন শর্ত বজায় থাকলে বাংলাদেশ এ কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়ালে দেশের অর্থনীতি পরিচালনার সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশে আর্থিক খাতের সংস্কারের গতি কমে যাবে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আগের সরকার স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা ধরে রাখার স্বার্থে যে প্রয়োজনীয় সংস্কার এড়িয়ে গেছে, তার পরিণতিতেই বাংলাদেশকে কঠিন সংকটে পড়তে হয়েছে। আমি মনে করি, কর্মসূচি চলমান রাখার স্বার্থে আরও আলোচনা চলুক।’
আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। শুরু হওয়ার তিন দিনের মাথায় ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে পাওয়া গেছে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার।
নিয়মানুযায়ী, কিস্তি পাওয়ার আগে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদনের দরকার পড়ে। চতুর্থ কিস্তি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের পর পাওয়ার কথা থাকলেও শর্ত পূরণ না হওয়ায় তা পিছিয়ে দেয় আইএমএফ। তখন অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির যে পর্ষদ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পিছিয়েছে। কিস্তি পেতে তাই দেরি হবে।
৫ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক হয়নি। এটা পিছিয়ে যায় ১২ মার্চ। ওই তারিখেও প্রস্তাব ওঠেনি। আবার তা পিছিয়ে যায় আগামী জুনে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ সাংবাদিকদের জানান, জুনে দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) অর্থ ছাড়ের প্রস্তাব একসঙ্গে উঠবে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের সভায়। সে লক্ষ্যে আইএমএফের একটি মিশন ঘুরে গেছে (৬-১৭ এপ্রিল)। কিন্তু কোনো সমঝোতা হয়নি।
তখন বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে। আলোচনা হয়ও। সেখানেও কোনো সুরাহা হয়নি। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ব্রিফ করে মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলে গেছেন, রিজার্ভের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিনিময় হারও এখন স্থিতিশীল। তবে মুদ্রার বিনিময় হার আরও নমনীয় হলে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ওয়াশিংটন থেকে গত ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার সময়টা কখন, তা নিয়ে দর কষাকষি চলছে।
গতকাল পর্যন্ত সমঝোতা না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ কর্মসূচিটি যে চালু রাখার দরকার, মনে হয় সরকার তা বোঝে। তাই বৈঠক হচ্ছে, যা ইতিবাচক। তবে আইএমএফকে বোঝাতে না পারার কারণ হচ্ছে, সরকার মুখে যা বলছে, বাস্তবে তা করছে না।’
জাহিদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, কয়লা, ভোজ্যতেল, গ্যাস—সবকিছুরই দাম কমছে। ফলে স্বস্তির সময় চলছে এবং বিনিময় হার নমনীয় করার এখনই ভালো সময়। যুক্তির বিচারে আইএমএফ এ কথাটিই বলার কথা। সরকার সংস্থাটিকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারছে না বলেই আইএমএফ রাজি হচ্ছে না এবং এত সুন্দর একটা কর্মসূচি আজ সমস্যার মধ্যে।