
উচ্চমূল্যের বাজারে এখনো কিছুটা হাতের নাগালে রয়েছে কেবল পাঙাশ মাছের দাম। ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিতে এ মাছ পাওয়া যায়। বাজারে মাছটির চাহিদা ও বিক্রি দুটোই ভালো। যদিও দাম কম হওয়ায় অনেকে এটাকে গরিবের মাছ বলে থাকেন। কিন্তু দেশে সাধারণের আমিষের আধারখ্যাত পাঙাশ মাছের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে আসছে। গত আট বছরে দেশে মাছটির মোট উৎপাদন কমেছে প্রায় এক লাখ সাত হাজার টন।
খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঙাশের দাম কমার মূল কারণ হলো, এটি চাষে আগের তুলনায় লাভের হার কমে আসছে।
মৎস্যচাষি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছের খাবারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। আর পাঙাশ মাছে রোগের প্রকোপ তথা মড়ক লাগার কারণেও মাছচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সে জন্য অনেকেই পাঙাশ চাষ ছাড়েন।
পাঙাশ মাছ থেকে সাধারণ মানুষের আমিষের বড় সরবরাহ আসে। তাই আমিষের ‘সস্তা উৎস’খ্যাত পাঙাশের উৎপাদন কমলে সাধারণ মানুষের মাছ খাওয়া কমে তাঁদের পুষ্টি নিরাপত্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন পুষ্টিবিশেষজ্ঞ ও কৃষি অর্থনীতিবিদেরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, আমিষের সস্তা উৎস পাঙাশের উৎপাদন কমলে সাধারণ মানুষের মাছ খাওয়া কমে যাবে। এতে পুষ্টি নিরাপত্তার ঘাটতি তৈরি হতে পারে। কারণ, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে অন্য মাছ কিনতে গিয়ে মানুষ খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন। তাই সরকারকে প্রয়োজনে ঋণসহায়তা দিয়ে চাষিদের পাশে থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশে মূলত চাষ হচ্ছে থাই জাতের (থাইল্যান্ড) পাঙাশ। নব্বইয়ের দশকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এই মাছের চাষ শুরু হলেও গত দেড় দশকে এটি সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬–১৭ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ১০ হাজার টন পাঙাশ উৎপাদন হয়েছিল। এর পর থেকেই উৎপাদন কমতে শুরু। পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৭–১৮ অর্থবছরে উৎপাদন কমে হয় ৪ লাখ ৫৩ হাজার টন। ২০২০–২১ অর্থবছরে উৎপাদন আরও ৫০ হাজার টন কমে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৪ লাখ ৩ হাজার টন। যদিও পরের বছর উৎপাদন কিছুটা বাড়ে। আট বছরের ব্যবধানে অবশ্য দেশে পাঙাশের উৎপাদন প্রায় এক লাখ সাত হাজার টন কমেছে।
পাঙাশ চাষে অনেক খাবারের প্রয়োজন হয়। তাই খাদ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, এই মত দেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আসফ-উদ্-দৌলাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে পাঙাশ চাষ করে বড় ব্যবসায়ী হলেও এখন কম লাভ হওয়ায় আর থাকতে চাচ্ছেন না। আবার হ্যাচারিগুলো নিয়ম না মানায় পোনা বড় হতেও সময় লাগছে। অন্যদিকে মাছে মড়ক লাগার কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাঙাশ চাষ ছেড়েছেন। পাঙাশের রোগ প্রতিরোধে দেশে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি। তা ছাড়া ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাঙাশ মাছকে রোগবালাইমুক্ত রাখা যায় বলে জানান এই বিজ্ঞানী।
মৎস্য কর্মকর্তারা বলছেন, পাঙাশ মাছ বড় হতে এক বছরের মতো সময় লাগে। অন্যদিকে তেলাপিয়া পাঁচ–ছয় মাসেই বিক্রির উপযোগী হয়ে যায়। এ কারণেও অনেকে পাঙাশ ছেড়ে তেলাপিয়া বা অন্য মাছ চাষে ঝুঁকছেন। সে কারণেই হয়তো শিং, মাগুর, ট্যাংরা ও পাবদা মাছের চাষ বেড়েছে।
জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোতালেব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চাষিরা পাঙাশে লাভ কম পাচ্ছেন। তাই তাঁরা অন্য মাছের চাষ বাড়াচ্ছেন। আবার মানুষও পাঙাশ খাওয়া কমাচ্ছেন।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের পুকুরগুলোতে মোট পাঙাশ উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৪ হাজার ৯৬৩ টন। ময়মনসিংহ জেলায় সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩৭ হাজার ১৩৩ টন পাঙাশ উৎপাদন হয়, যা মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ হাজার ৪৫৬ টন পাঙাশ উৎপাদন হয় কুমিল্লা জেলায়। ২৬ হাজার ২০৮ টন নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বগুড়া।
এ ছাড়া যশোরে ১৬ হাজার ৬৭০, নরসিংদীতে ৬ হাজার ৯০, নেত্রকোনায় ৫ হাজার ৭২২, নাটোরে ৫ হাজার ৫৪৯, লক্ষ্মীপুরে ৫ হাজার ২৭৮, টাঙ্গাইলে ৪ হাজার ১৭৯ ও কিশোরগঞ্জে ৪ হাজার ১৫৯ মেট্রিক টন পাঙাশ উৎপাদন হয়েছে। এই ১০ জেলা থেকেই আসে পুকুরে চাষ হওয়া মোট পাঙাশের ৬৩ শতাংশ।
বিভিন্ন জায়গার মাছচাষিরা জানান, বর্তমানে এক কেজি পাঙাশ উৎপাদনে খরচ হয় ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। আর তাদের বিক্রি করতে হয় ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। বাজার খারাপ থাকলে আরও কমে ছাড়তে হয়। তাই মুনাফা হয় খুব কম।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে প্রায় ১২ একর পুকুরে পাঙাশ চাষ করেছেন জহির রায়হান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ ক্রেতারা পাঙাশ খায় বেশি। কিন্তু এখন তাঁদের হাতে টাকা নেই, আয় কমে গেছে। তাই মাছের চাহিদাও কমেছে। তিনি আরও বলেন, গত বছরের বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েও অনেকে মাছ চাষ ছেড়েছেন। পাঙাশ রপ্তানি করা গেলে চাষি, খামারি ও ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পেতেন।
ময়মনসিংহের খামারি নাদিম মাহমুদ বলেন, লাভ বেশি হওয়ায় অনেকে এখন পাঙাশ ছেড়ে তেলাপিয়া চাষ করছেন। তিনি জানান, খামারে মড়ক লাগায় গত জুলাই মাসে তাঁর প্রায় পাঁচ টনের মতো পাঙাশ মাছ মরে গেছে।
মাছচাষিরা জানান, পাঙাশ মাছ উৎপাদনে ৭০–৮০ শতাংশ ব্যয় হয় খাবারের পেছনেই। পোনায় ১০ শতাংশ এবং বাকি খরচ যায় পানি, পরিবহন ও শ্রমিকের বেতনে। পাঙাশের প্রতি টন খাবারের দাম ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা।
পাঙাশ মাছের জন্য প্রচুর খাবারের প্রয়োজন হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের ডিন অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম সরদার বলেন, মাছের খাবারের দাম বেশি। দীর্ষ সময় লাগে পাঙাশ চাষে। তাই খাবারের দাম না কমালে চাষিদের পক্ষে পাঙাশ চাষ কঠিন হয়ে যাবে।
মাছের খাবারের দাম বেশি স্বীকার করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। প্রথম আলোকে তিনি পাঙাশের খাবারের দাম কমানোর জন্য গবেষণায় জোর দেন। বলেন, খাবারের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বিশেষ করে বিদেশি খাবারের দাম বেশি। সার–কীটনাশক ও শিল্পবর্জ্যের কারণে মুক্ত জলাশয়েও মাছের উৎপাদন কমছে বলে জানান তিনি।