ঘটনা কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির। গত বছর করোনা সংক্রমণের সময় লকডাউন চলছিল, এর মধ্যে বাসা ভাড়া দিতে না পেরে মাসের পর মাস লুকিয়ে ছিলেন এক মোটরসাইকেলচালক। তবে এ বছর আবার কাজে ফিরেছেন তিনি। ধীরে ধীরে পরিশোধ করছেন ঋণ।
এদিকে স্থানীয় কলেজ খুলে দেওয়ায় জাম্বিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক কৃষক হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। কলেজ খুলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা খাদ্য হিসেবে তাঁর ফসল কিনে নেবেন, এই আশায় তিনি আবার ভালো দিনের স্বপ্ন বুনছেন।
ওদিকে ভারতের রাজধানী দিল্লি শহর যখন প্রায় অচল করে দেওয়া হলো, অনেকেই তখন গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যান। আবার শহর জাগতে শুরু করলে লোকজনও কাজের খোঁজে ফিরতে শুরু করেন।
বিষয়টি হলো, করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে লকডাউন দেওয়া হয়। শুরু হয় চাকরির খরা, মানুষের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় কষ্ট। এই ভাইরাসকে দূরে রাখতে শুরু হয় তীব্র লড়াই। লাখ লাখ মানুষ আবার দারিদ্র্যের কাতারে নেমে যায়।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়। নতুন উদ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম। অনেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের ওয়ার্ল্ড পোভার্টি ক্লকের হিসাবে, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ দৈনিক ২ ডলারের কম আয় করেন, এমন মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ কোটি। কিন্তু এই বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা কমে ৬৮ কোটি ৫০ লাখে নেমে আসতে পারে, অর্থাৎ মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরে যাবে। তবে এই দারিদ্র্য হ্রাসে সময় লাগবে।
আইএমএফ বলেছে, ২০২২ সালে কিছু ধনী দেশের প্রবৃদ্ধির হার গরিব দেশগুলোর তুলনায় বেশি হবে। কিন্তু গত দুই বছরে এমন কিছু ক্ষতি হয়েছে, যা কোনো দিন পূরণ করা সম্ভব হবে না। শিশুদের মধ্যে খাবার না খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করানোর কারণে দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা তৈরি হতে পারে। যাঁরা ভয়ে সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন, সেই সম্পদ আবারও কিনতে হলে তাঁদের কয়েক বছর সঞ্চয় করতে হবে।
মধ্য আয়ের দেশগুলোতে যারা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে বসবাস করত, তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে এশিয়ায় আবারও দারিদ্র্য বেড়েছে। বিশেষ করে ভারতে লাখ লাখ মানুষকে নতুন করে লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু এই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থমকে গেলে দারিদ্র্য আবারও বেড়ে যাবে, বিশেষ করে আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চল ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতে। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের তথ্যমতে, ২০৩০ সাল নাগাদ ২ ডলারের নিচে যাঁদের আয়, তাঁদের ৬০ শতাংশের বসবাস হবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতে। আর স্থিতিশীল দেশগুলো চরম দারিদ্র্যসীমার লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে দারিদ্র্য নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২২ সালে দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রতি ১০ জনের ১ জন হবেন শহরাঞ্চলের বাসিন্দা। অনেকেই বাড়ির পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা রাস্তায় খাবার ফেরি করার মতো কাজ খুঁজবেন। যতক্ষণ না ভোক্তাদের আস্থা ফিরছে এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে, ততক্ষণ কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
গত অক্টোবর মাসে স্পেন, সিঙ্গাপুরের মতো কিছু দেশ জনসংখ্যার তিন–চতুর্থাংশকে টিকা দিতে পেরেছে। কিন্তু ইথিওপিয়া ও উগান্ডার মতো দেশগুলো মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম মানুষকে পূর্ণ ডোজ দিতে পেরেছে। চলতি বছর তো বটেই, এরপরও এই বৈপরীত্য বজায় থাকবে।
অন্যদিকে নারী-পুরুষের ব্যবধান আরও বাড়বে। দাতব্য সংস্থা অক্সফামের হিসাবে, ২০২০ সালে বিশ্বে নারীদের আয় অন্তত ৮০ হাজার কোটি ডলার কমেছে। অনেক নারী চাকরি হারিয়েছেন বা মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে পারছে না। সঠিক সময় বা পরিকল্পনার আগে অনেক নারীর বিয়ে হয়ে গেছে বা এমনকি তাঁরা মা-ও হয়েছেন। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ জন পুরুষের বিপরীতে ১২১ জন নারী দরিদ্র হবেন। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১১৮।
তবে এত আশঙ্কার মধ্যে কিছুর আশার কথাও আছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত দরিদ্রদের নগদ অর্থ প্রদানসহ ৩ হাজার ৩০০-এর বেশি সামাজিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। ধনী দেশগুলো সরকারি ঋণ পরিশোধ স্থগিত করেছে। চরম দারিদ্র্য দূর করা অসম্ভব নয়, বলা হচ্ছে, বিশ্বের সব মানুষের প্রতিদিনের আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের ওপরে নিতে দরকার ১০ হাজার কোটি ডলার। সহায়তা ও ব্যক্তিগত বদান্যতার মধ্য দিয়ে এই অর্থ জোগাড় করা সম্ভব।