বিটকয়েনকে একসময় মনে করা হতো ডিজিটাল সোনা। কোভিডের সময় বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা অনিশ্চয়তায় বিটকয়েনের দাম অনেকটাই বেড়েছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে-পরেও দাম বেশ কিছুটা বেড়েছিল।
কিন্তু চলতি বছর সোনার দাম ৭১ শতাংশ বাড়লেও বিটকয়েনের দাম ৬ শতাংশ কমেছে, অর্থাৎ ক্রেতারা ডিজিটাল সোনা ছেড়ে প্রকৃত সোনার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। অনিশ্চয়তার মধ্যে বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
দ্য গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়েছে, তাত্ত্বিকভাবে সোনার মতো বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধিরও বাস্তবতা ছিল এ বছর। অনিশ্চয়তার সময় বিনিয়োগকারীরা বিটকয়েনেও বিনিয়োগ করে থাকেন। সেই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাও সারা বছর বেশ ভালোই ছিল। বছরের শেষ ভাগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেলবাহী ট্যাংকার আটকে দিয়ে তাতে আরও ঘি ঢেলেছেন।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধির বাস্তবতা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি চরম পর্যায়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটির জাতীয় ঋণের পরিমাণ এখন মোট জাতীয় আয়ের ১২৫ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ১৪৩ শতাংশে উঠবে, অর্থাৎ ইতালি ও গ্রিসের মতো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ বেড়ে যাবে।
আরেকটি বিষয় প্রযুক্তিগত। বিটকয়েনকে যদি প্রযুক্তিনির্ভর উচ্ছ্বাসের বাহন হিসেবে ধরা হয়, তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বিপ্লব তার পালে অন্তত কিছুটা হাওয়া দেবে—এমনটাই কথা ছিল। এআই-বিষয়ক সম্পদের অতিমূল্যায়ন হচ্ছে কি না, তা নিয়ে এখন বিস্তর বিতর্ক আছে। তা সত্ত্বেও চলতি বছর এআইয়ের প্রাণভোমরা হিসেবে পরিচিত চিপ কোম্পানি এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম এখনো প্রায় ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকাও স্পষ্টভাবে বিটকয়েনের সহায়ক ছিল। মূলধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ-ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) বাজারজাত করছে। তবে ক্রিপ্টো নিয়ে যুক্তরাজ্যের আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সতর্ক। তারা ক্রিপ্টো বাজারের অনেক ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণে আনার প্রস্তাব দিয়েছে।
এখানেই সম্ভবত বিটকয়েনের দাম পড়ে যাওয়ার আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। সেটা হলো আর্থিক খাতের মূলধারায় জায়গা করে নেওয়ার পরও বিটকয়েন অনেকটাই একঘেয়ে। জেপি মর্গান ও ব্ল্যাকরকের মতো প্রতিষ্ঠান যখন বিটকয়েনকে সাধারণ সম্পদশ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করে, তখন তার বিপ্লবী চরিত্র কিছুটা হারিয়ে যায়। গুগলে ‘বিটকয়েন’ শব্দটি খোঁজার প্রবণতা এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। ইলন মাস্কও এখন বিটকয়েন নিয়ে টুইট করছেন না। তাঁর হাতে এখন আরও অনেক বিষয় আছে।
কেন এই অবস্থা
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবর মাসে এসে সোনা ও বিটকয়েনের গতিপথ প্রকৃত অর্থেই আলাদা হয়ে যায়, সে সময় বিটকয়েনের দ্রুত দরপতন ঘটে। ১০ অক্টোবর ঠিক কী ঘটেছিল, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। তবে চীনের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়া নিয়ে ট্রাম্পের এক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তুলনামূলকভাবে ছোট বাজারে বিপুল পরিমাণ বিটকয়েন বিক্রি হয়ে যায়।
মূল কথা হলো শেয়ারবাজার ও মূল্যবান ধাতুর মতো বিটকয়েন এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পুরো ক্রিপ্টো বাজারের মূল্য ছয় সপ্তাহে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারের বেশি কমে যায়। অক্টোবরের শুরুতে বিটকয়েনের দাম ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ডলার। সেই দাম এখন কমে হয়েছে ৮৭ হাজার ডলার।
এক মাস আগে প্রকাশিত এক গবেষণা নোটে ডয়চে ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা বিটকয়েনের দরপতনের পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেন। সেগুলো হলো অক্টোবরে বাজারজুড়ে ‘ঝুঁকি এড়ানোর’ প্রবণতা, সুদের হার নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের কড়া বার্তা, প্রত্যাশার তুলনায় নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত অগ্রগতির ঘাটতি, তারল্যের স্বল্পতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অর্থ প্রত্যাহার। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা তুলে নেওয়া।
ডয়চে ব্যাংকের বিশ্লেষকদের উপসংহার ছিল, এই সংশোধনের পর বিটকয়েন স্থিতিশীল হবে কি না, তা অনিশ্চিত। আগে পতন হতো খুচরা বিনিয়োগকারীদের জল্পনার কারণে। কিন্তু এবার বিষয়টি সে রকম নয়; বরং উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ও নীতিগত অগ্রগতি সত্ত্বও এবং বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবণতার পটভূমিতে এবারের এ দরপতন। ফলে এ প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদি হবে বলেই শঙ্কা।
শেয়ারবাজারে বিনিয়েগাকারীদের মতো খাঁটি বিটকয়েন বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস, প্রতিটি ধাক্কাই নতুন করে কেনার সুযোগ নিয়ে আসে। তাঁদের আস্থা সাধারণত টলে যায় না। আগের বছরগুলোতে বড় পতনের পর ক্রিপ্টোকারেন্সিটি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে এই বিনিয়োগকারীদের যে পুরোপুরি ভুল বলা যায়, তা–ও নয়।
তবু এ বছর যেন কোথাও একটা চিড় ধরেছে। প্রকৃত অর্থেই বিনিয়োগকারীরা যখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন, তখন তাঁরা কম্পিউটার কোডের ওপর ভরসা না করে সোনা ও রুপার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যে প্রযুক্তি এখনো ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি, তার প্রতি আগ্রহ কমেছে। বছরের শেষদিকে এসে তাই বিটকয়েন ও অন্যান্য মুদ্রার বাজারের গভীরতা কতটা—সে প্রশ্নও উঠছে। আগের মতো উত্তেজনা আর নেই।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য বলেন, বিটকয়েন বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে সোনার চেয়েও বেশি অস্থির। বিটকয়েনের মৌল ভিত্তি নেই। ফলে এটির বাজারে বুদ্বুদ তৈরি হলে তা খুব সহজেই ফেটে যেতে পারে। তাতে পুঁজি হারাতে পারেন অনেকে।
তাই বিশ্লেষকদের বড় একটি অংশ মনে করছেন, বিটকয়েন কখনো সোনার বিকল্প হতে পারে না।