
নিজের বসত কিংবা অ্যাপার্টমেন্টে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করার উপায় যেন আটকে রাখছি আমরা। ভবনে প্রাকৃতিক আলো-ছায়ার নানা ভাবনা প্রথম আলোকে জানাচ্ছেন স্থপতি নাহাস আহমেদ খলিল। তিনি স্থপতি ও নগর–পরিকল্পনাবিদ। তিনি এআরসি আর্কিটেকচারাল কনসালট্যান্সের প্রিন্সিপাল আর্ক্টিটেক্ট।
প্রাকৃতিক আলো-বাতাস শুধু আমাদের শরীর নয়, মননের বিকাশেও গভীর প্রভাব ফেলে। সূর্যের আলো, বিশেষ করে সকালের আলো, আমাদের দেহঘড়ি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের ঘুমচক্র ও সামগ্রিক মননের বিকাশকে প্রভাবিত করে। গবেষণা দেখায়, প্রাকৃতিক আলো শিশুদের চোখের স্বাস্থ্য ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ভিটামিন ডি সংশ্লেষণে সূর্যের আলোর ভূমিকা সর্বজনবিদিত। হাড়ের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার জন্য জরুরি প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের গুরুত্ব অনেক। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্মুক্ততা প্রশান্তি এনে দেয়। আলো-বাতাসের মধ্যে অবস্থান মানসিক চাপ কমায় এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে।
মুক্ত বাতাস নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আমাদের মতো দেশে বছরজুড়ে সহনশীল উষ্ণতা বিরাজ করে। এখানে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ শরীরের ঘাম শুকিয়ে শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে শীতল রাখতে সাহায্য করে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঘরের তাপমাত্রা ধরে রাখার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়, কিন্তু আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহই সর্বোত্তম সমাধান। বর্তমানে এসি-নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে যেমন কার্বন ফুটপ্রিন্ট বৃদ্ধি হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আমাদের শরীরকে প্রাকৃতিক শীতলীকরণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এসির কৃত্রিম ঠান্ডা বাতাস আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। শুষ্ক পরিবেশ সৃষ্টি করে যা ত্বক ও শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
ঢাকা শহরের চ্যালেঞ্জ
ঘনবসতিপূর্ণ শহর ঢাকার জনবসতি অত্যন্ত নিবিড়। সিঙ্গাপুরের মতো শহরগুলোতে জমির স্বল্পতার কারণে উল্লম্ব উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ ঘনত্ব মোকাবিলা করা হয়। তবে ঢাকার শহুরে বিকাশ কিছুটা ভিন্ন। পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক কাঠামোতে ঘিঞ্জি গলি ও কাছাকাছি ভবন দেখা যায়। ব্রিটিশ আমলের বাগান আর সবুজনির্ভর দালান নির্মাণ করতে দেখা যায়। ধানমন্ডির মতো অনেক এলাকায় আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়ি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই আধুনিক ফ্ল্যাট নির্মাণে অনেক সময় প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলে শিশুরা পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম আলো বা পর্দার নীল আলো শিশুদের ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত ঘটায়। মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশে বাধা দেয়। প্রাকৃতিক আলোর অভাবে শিশুরা ঘরের মধ্যে বন্দী থেকে স্ক্রিন–আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের সামাজিক ও জ্ঞানীয় বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শহুরে পরিবেশে উন্মুক্ত খেলার জায়গার অভাবেও শিশুরা প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ভবনের পরিকাঠামো ও উচ্চতা এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে অনেক সময় পার্শ্ববর্তী ভবনের কারণে সূর্যের আলো ও বায়ুপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের শহরে অপরিকল্পিত নির্মাণ প্রায়ই এ সমস্যার কারণ। ভবন থেকে ভবনের পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখতে না পারার কারণে বায়ু চলাচল ব্যাহত হয়, যা ঘরের ভেতরের পরিবেশকে উষ্ণ ও গুমোট করে তোলে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সুচিন্তিত নগর–পরিকল্পনা এবং ভবন নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করা অপরিহার্য।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়
হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামবাংলার স্থাপত্যে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের সার্থক ব্যবহার দেখা যায়। গ্রামের বাড়িতে দক্ষিণমুখী জানালা ও বারান্দা দখিনা বাতাসের প্রবেশ নিশ্চিত করত। বাড়ির চারপাশে ছায়াঘেরা গাছপালা সূর্যের তীব্র তাপ থেকে সুরক্ষা দেয়, যা দিনের বেলায়ও ঘরে শীতল পরিবেশ বজায় রাখতে সাহায্য করত। ঐতিহ্যবাহী সেই জ্ঞানকে আধুনিক স্থাপত্যে পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি।
এখন তাপপ্রবাহ অনেক সময় একটি বড় সমস্যা। জানালার অবস্থান ও থাকার ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা আলো ও তাপের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক ওরিয়েন্টেশন ও জানালা–দরজার বিন্যাস ক্রস-ভেন্টিলেশন নিশ্চিত করতে পারে। আগে বারান্দা কেবল একটি অতিরিক্ত স্থান ছিল না। বারান্দার অবস্থান যেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বাড়ির সংযোগস্থল। সূর্যের তাপনিয়ন্ত্রণ ও বায়ুপ্রবাহের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য উপাদান। আধুনিক ফ্ল্যাটগুলোতে বারান্দার আকার ছোট হয়ে যাওয়ায় এর কার্যকারিতা কমেছে।
শহরে ভবন থেকে ভবনের দূরত্ব বাড়াতে পারলে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ছাড়া ভবনের উচ্চতা ও বিন্যাস এমনভাবে নকশা করা উচিত, যেন তা প্রতিবেশী ভবনগুলোর আলো-বাতাস প্রবেশের পথে বাধা না হয়। উল্লম্ব ঘনত্বের সঙ্গে প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয় সাধন করে একটি সুস্থ জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। এসব কিন্তু শুধু ভবনের নকশা নয়, বরং সামগ্রিক নগর–পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বহুপ্রজন্মের বাসস্থান
অনেক পরিবারে দুই বা তিন প্রজন্মের বসবাস দেখা যায়, যেখানে দাদা-দাদি, মা–বাবা ও শিশুরা একই ছাদের নিচে থাকে। এ ধরনের বাসাবাড়িতে ড্রয়িং-ডাইনিংয়ের মতো কেন্দ্রীয় স্থানে প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এটি কেবল পারিবারিক মিথস্ক্রিয়াকে উৎসাহিত করে না, বরং পুরো পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বজায় রাখতেও সহায়তা করে। দিনের বেলায় এই স্থানগুলো আলোকিত ও বায়ু চলাচলপূর্ণ থাকলে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
ছাদবাগান
শহুরে বিভিন্ন ভবনে ছাদবাগানের ব্যবহার ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। এসব বাগান পরিবেশগত সুবিধা দেয়। সামাজিক ও মানসিক বিকাশেও ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে কিশোরীদের জন্য যারা মাঠে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য ছাদবাগান একটি নিরাপদ ও সুন্দর বিনোদনস্থল হিসেবে কাজ করতে পারে। এখানে তারা বাগান করা, খেলাধুলা ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। ছাদবাগান শিশুর সঙ্গে বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ ও সৃজনশীলতাকে উন্নত করে। ছাদবাগান শহুরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
আরবান হিট আইল্যান্ড প্রভাব
ঢাকা শহরকে আরবান হিট আইল্যান্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঢাকা শহর থেকে একটু বাইরের এলাকায় গেলেই কয়েক ডিগ্রি তাপমাত্রা কমতে দেখা যায়। শহরটি গ্রামীণ পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ থাকে। কংক্রিট ও অ্যাসফল্টে আবৃত পৃষ্ঠ সূর্যের তাপ শোষণ করে রাতের বেলা তা নির্গত করে। কম গাছপালা, অপর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহ এবং মানবসৃষ্ট তাপ (যেমন যানবাহন ও এসি থেকে নির্গত) এ প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এ কারণে শহরের তাপমাত্রা বাইরে বের হতে পারে না। আশপাশের ঠান্ডা বাতাস বাইপাস করতে পারে না, যা সামগ্রিক আবহাওয়াকে অস্বস্তিকর করে তোলে। এ সমস্যা মোকাবিলায় সবুজ ছাদ, উল্লম্ব বাগান আর উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
অনুলিখিত