Thank you for trying Sticky AMP!!

শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার—এখনই বাস্তবায়নে সক্ষমতা আছে তো?

নানা আলোচনা শেষে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) বাস্তবায়ন শেষে আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হতে যাচ্ছে (প্রথম আলো, ৩০ মে)। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণি র্পযন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকম শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম— দুটোই থাকছে। আজকের আলোচনায় আমরা শুধু সক্ষমতা নিয়ে বিশ্লেষণ করব।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা হচ্ছে না—কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষার চাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার এই নীতিমালা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। কিন্তু পরীক্ষার পরিবর্তে আনন্দমুখর পরিবেশে নিজেদের প্রতিভা বিকাশে কোমলমতি শিশুদের ব্যস্ত রাখার পরিবেশ নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এ শিশুদের মুক্ত প্রতিভার বিকাশে সৃজনশীল দৈনন্দিন কাজের উপযোগী বিদ্যালয়ের পরিবেশ, খেলার মাঠ, পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকলে পরীক্ষা পদ্ধতি উঠে যাওয়ার যে সুফল আমরা আশা করছি, তা না–ও পেতে পারি।

শোনা যাচ্ছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাত্রাতিরিক্ত নতুন বই ও শিখন উপকরণ শিক্ষার্থীদের ভারাক্রান্ত করবে না। সে লক্ষ্যেই জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ এ পাঠ্যবইগুলো শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত করবে। কিন্তু কিভাবে তা অর্জন করা হবে, সেই পথপরিক্রমা সুস্পষ্ট নয়।

একটি দেশের বাধ্যতামূলক শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দশ্যে হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নাগরিক দায়িত্ব পালন করা, যেমন—ওই দেশের ট্রাফিক আইন মেনে চলা কিংবা যত্রতত্র ময়লা না ফেলে কিংবা অন্য নাগরিকের রাতের ঘুম নষ্ট করে নিজের বাড়িতে উচ্চস্বরে গান না শোনা, অর্থাৎ অন্যের মৌলিক অধিকার হরণ না করা। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক শিক্ষা কার্যক্রম এ দেশের নাগরিকদের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তর। একেকটি স্তরের শিক্ষা তার পরবর্তী স্তরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ তত্ত্বটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তা মেনে চলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলেই শিক্ষাবিদেরা মনে করে থাকেন, যেমন—নতুন কারিকুলামে বিভিন্ন মহলে মতবিনিময় করার কথা বলা হলেও ওই সমন্বয় কিভাবে করা হয়েছে, তা সুস্পষ্ট নয়। মনে রাখা দরকার, একটি সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট সমন্বিত নীতিমালা থাকা জরুরি।

বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ খুবই প্রয়োজন। যদিও বলা হচ্ছে, এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে, কিন্তু দেশব্যাপী সব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগেই যথাযথ ট্রেনিং শেষে করতে পারবেন—অতীত অভিজ্ঞতা এতটা আশাবাদী করে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যাঁরা নতুন কারিকুলামে শিক্ষাদান করবেন, সেই শিক্ষকদের সংস্কার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং বাস্তবায়নে আশু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পারদর্শী করে তোলা জরুরি।

উন্নত দেশগুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুফল পেতে শিক্ষকপ্রতি ১৩ থেকে ১৫ জন ছাত্রছাত্রী আদর্শ সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সারা দিন গল্পে গল্পে কাজ করবেন, অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন, শেখাবেন এবং পরিশেষে মূল্যায়ন করবেন। আমাদের ক্ষেত্রে কোমলমতি শিশুদের যথাযথভাবে না শিখিয়ে আমরা শুধু তাদের মূল্যায়ন করছি না তো?

নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের (শিখনকালীন) ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক ও যুগোপযোগী। কিন্তু এটি কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা সুস্পষ্ট নয়। আমরা কি এমন মানের শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছি, যাঁরা যথাযথভাবে শিখনকালীন মূল্যায়ন করতে পারবেন? স্বাধীনভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হলে শিক্ষকদের আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে হবে এবং একই সঙ্গে দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে। মনে রাখা দরকার, এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সততার অভাবে পুরো সংস্কার প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে।

বাজারে প্রচলিত গাইড বই কিংবা শিক্ষকদের আর্থিক সংগতি বাড়িয়ে প্রাইভেট টিউশন বন্ধ না করে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুফল পাওয়া অনেকাংশেই আকাশকুসুম কল্পনা। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত ও এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

পরিশেষে বলা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতিতে আমরা বিদ্যমান শিক্ষকদের সৃজনশীল না বানিয়ে কিংবা সৃজনশীল নতুন শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছিলাম। বাজারের গাইড বই বিদ্যমান আইনের প্রয়োগে বন্ধ করতে পারিনি। এভাবে আরও অনেক ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিয়ে তোলে।
এক কথায় নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য জ্ঞান অর্জন করবে ও সেই জ্ঞান প্রয়োগ করবে। ফলে শিখন মুখস্থনির্ভর থাকছে না। শিক্ষা কার্যক্রম যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার বহিঃপ্রকাশ একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। কিন্তু তা বাস্তবায়নের আগে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রায়োগিক দিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের আরও সুচিন্তিতভাবে ভেবে দেখতে হবে, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই এই সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য এ মুহূর্তে সক্ষম কি না।

লেখক: মুহাম্মদ আবদুর রহমান ফরহাদ, সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর