
বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিএইচডি থাকলেও বিসিএস সাধারণ শিক্ষাসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের কেন পিএইচডি থাকে না, এর উত্তর পাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিসিএস ক্যাডারদের পদোন্নতি ও নিয়োগ বিধিমালায় চোখ বোলাতে হবে।
শিক্ষাসহ সিভিল সার্ভিসের অন্য ক্যাডারদের চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির মধ্যে বেশ কিছু কাঠামোগত পার্থক্য রয়েছে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বড় অংশ কলেজে পাঠদান করলেও তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন দপ্তর ও শিক্ষা বোর্ডে কর্মরত। ফলে অন্য ক্যাডারের মতো তাঁরাও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গবেষণা ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত থাকেন। ফলে বিসিএস ক্যাডারদের ক্ষেত্রে পিএইচডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক নয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় উচ্চপর্যায়ের পদোন্নতির জন্য পিএইচডি গুরুত্বপূর্ণ।
বিসিএস ক্যাডারদের চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট বিধি অনুসরণ করতে হয়। প্রাথমিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রবেশনারি (প্রশিক্ষণকাল) অবস্থায় থাকেন এবং সন্তোষজনক কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের পর স্থায়ী নিয়োগ পান।
স্থায়ীকরণের শর্তাবলি
১. প্রবেশনের সময়: সাধারণত দুই বছর মেয়াদি প্রবেশনের সময় শেষে কর্মদক্ষতা ও আচরণ মূল্যায়নের মাধ্যমে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। কর্মদক্ষতা সন্তোষজনক না হলে চাকরি বাতিল বা প্রবেশনের সময় বৃদ্ধি করা হতে পারে।
২. বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা: বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়
ক. আইন ও বিধি (প্রথম পত্র)
খ. হিসাব (দ্বিতীয় পত্র)
গ. সংশ্লিষ্ট ক্যাডারভুক্ত কার্যক্রম–সংক্রান্ত বিষয়াবলি
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক।
৩. বনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স: নির্ধারিত বনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স (Foundation Training Course-FTC) সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পদোন্নতির জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা, ২০১৭ অনুসারে বিসিএস ক্যাডারদের পদোন্নতি নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে হয়।
ক. পদোন্নতির ন্যূনতম যোগ্যতা
১. প্রয়োজনীয় চাকরিকাল: সাধারণত সিনিয়র স্কেল বা উচ্চ পদে পদোন্নতির জন্য ন্যূনতম পাঁচ বছর চাকরিকাল প্রয়োজন।
২. সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা: নির্ধারিত ক্ষেত্রে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা বা পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।
৩. চাকরিজীবনের মূল্যায়ন: সন্তোষজনক কর্মদক্ষতা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও বিভাগীয় মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হতে হয়। গুরুতর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকলে পদোন্নতি ব্যাহত হতে পারে।
৪. শূন্য পদের ভিত্তিতে পদোন্নতি: শুধু শূন্য পদ থাকলেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। লিয়েন বা চলতি দায়িত্বে থাকা শূন্য পদে সরাসরি পদোন্নতি সম্ভব নয়।
খ. পদোন্নতি পরীক্ষা ও বিষয়গুলো
সাধারণত ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতির জন্য বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক পরীক্ষা নেওয়া হয়।
১. বাংলাদেশ ও সমসাময়িক বিষয়াবলি
২. সরকারি অফিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আইন, বিধি ও পদ্ধতি
৩. সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের কার্যাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াবলি
সার্ভিসে থাকার শর্ত ও সীমাবদ্ধতা
* স্থায়ী না হলে পদোন্নতি পাওয়া যাবে না।
* সর্বোচ্চ ১৪ বছরের চাকরির মেয়াদ পার হলে পদোন্নতি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যাবে না।
* পদোন্নতির জন্য সংশ্লিষ্ট ক্যাডার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ওপর জোর দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ নীতিমালা
১. লেকচারার
* স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বাধ্যতামূলক।
* গবেষণা অভিজ্ঞতা ও প্রকাশনা অগ্রাধিকার পায়।
২. সহকারী অধ্যাপক
* স্নাতকোত্তর বা এমফিল অথবা পিএইচডি আবশ্যক। গবেষণা ও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
৩. সহযোগী অধ্যাপক
* স্নাতকোত্তর বা এমফিল অথবা পিএইচডি আবশ্যক। উল্লেখযোগ্য গবেষণা প্রকাশনা ও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
৪. অধ্যাপক
* স্নাতকোত্তর কিংবা এমফিল অথবা পিএইচডি আবশ্যক। উচ্চমানের গবেষণা প্রকাশনা ও শিক্ষায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আবশ্যক।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০১৯ সালের খসড়া অনুযায়ী
১. সহকারী অধ্যাপক: পিএইচডি থাকলে এক বছর, এমফিল থাকলে দুই বছর ও শুধু স্নাতকোত্তর থাকলে তিন বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আবশ্যক। স্বীকৃত জার্নালে তিনটি গবেষণা প্রকাশনা থাকতে হবে।
২. সহযোগী অধ্যাপক: পিএইচডি থাকলে ৭ বছর, এমফিল থাকলে ৯ বছর ও স্নাতকোত্তর থাকলে ১২ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আবশ্যক। সর্বনিম্ন ছয়টি গবেষণা প্রকাশনা প্রয়োজন।
৩. অধ্যাপক: সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ১০ বছরসহ মোট ২২ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ১২টি গবেষণা প্রকাশনা আবশ্যক।
বিসিএস ক্যাডারদের মূল দায়িত্ব প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা, যেখানে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলক কম। ফলে পিএইচডি বাধ্যতামূলক নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মূলত শিক্ষাদান ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকায় উচ্চপর্যায়ের পদোন্নতির জন্য পিএইচডি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পিএইচডি ডিগ্রিধারীর সংখ্যা বেশি, যেখানে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য তা অলংকারস্বরূপ।
না, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী নন। এমনকি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, যেমন পদার্থবিজ্ঞান, আইইআর (ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)-সহ কিছু বিভাগের কয়েকজন অধ্যাপকের এমফিল বা পিএইচডি নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মূলত পদোন্নতির শর্ত পূরণ ও দ্রুততম সময়ে অধ্যাপক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং কর্মজীবনের শেষ দিকে গ্রেড-১ অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ তাঁদের এমফিল বা পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আগ্রহী করে তোলে। শিক্ষাছুটি তাঁদের এ স্বপ্নযাত্রার পথকে মসৃণ করে। পক্ষান্তরে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির শর্তের ভিন্নতা, শিক্ষাছুটির জটিলতা ও উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের বিশেষ সুবিধা না থাকায় তাঁরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে আগ্রহী হন না।
*লেখক: সচিব তালুকদার, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরত