
১৯৫৩-৫৪ সালের কথা। তখন আমি ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি। সে সময় কলকাতার পূর্ণ সিনেমা হলে বসু পরিবার ছবিটি দেখি। তারপর উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সাড়ে চুয়াত্তর দেখি। তখন সুচিত্রা সেন কেবল একজন সুন্দর চেহারার অধিকারিণী অভিনয়শিল্পী। উত্তমকুমারও তখনো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। পরপর কয়েকটি ছবি ফ্লপ করেছে। তখন চাকরি করতেন। সিনিয়রদের কাছে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বলতে শুনেছি, কলকাতার চলচ্চিত্রে সুন্দর চেহারার একজন নতুন নায়িকা এসেছেন। এরপর সুচিত্রা ও উত্তমকুমার আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে থাকলেন। আমরা যখন টগবগে তরুণ, তখন উত্তম-সুচিত্রা জুটি হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হতে থাকল। বলা যায়, আমরা এই জুটি বলতে অজ্ঞানই ছিলাম। উত্তমকুমারকে তো আমি আমার আদর্শই মানি। সুচিত্রা সেনকে আমি শ্রদ্ধা করতাম, ভালো লাগত তাঁকে।
উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার পারিবারিক যোগাযোগ থাকলেও সুচিত্রার সঙ্গে কোনোকালেই ছিল না। অভিনয়শিল্পী হিসেবে সুচিত্রাকে আমি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করি। উত্তমকুমারকে নির্দ্বিধায় মহানায়ক বলতে পারি। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁকে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে পেয়েছি। তাঁর জীবনে নানা চড়াই-উতরাই এসেছে। এর পরও তিনি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অভিনয়ের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তাঁকে মহানায়ক হিসেবে স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু মহানায়িকা হিসেবে সুচিত্রা সেনকে মানতে পারি না। তবে, সুচিত্রা অত্যন্ত উঁচু মাপের একজন অভিনয়শিল্পী। তাঁকে রোমান্টিক ছবির আন-প্যারালাল হিরোইন কিংবা পশ্চিমবঙ্গের রোমান্টিক ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী একজন অভিনেত্রী বলা যায়। কিন্তু অনেক দিন ধরে তিনি নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখলেন।
সুচিত্রা সেন যে কদিন কাজ করে গেছেন, রোমান্টিক ছবিতে কাজ করে গেছেন। বৈচিত্র্যময় চরিত্রে আমরা কিন্তু তাঁকে তেমন পাইনি। সাবিত্রী চ্যাটার্জি, মাধবী মুখার্জি, সুপ্রিয়া দেবী, নার্গিস, সুরাইয়া কিংবা অন্য কয়েকজন অভিনয়শিল্পীকে আমরা কিন্তু অনেক বৈচিত্র্যময় চরিত্রে পেয়েছি। সুচিত্রা সেন শুধু গ্ল্যামার ছবির চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। সুচিত্রা সেনের যত ছবি হয়েছে, প্রায় সবই রোমান্টিক ঘরানার। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের সঙ্গে কিন্তু সুচিত্রা সেনের কোনো কাজ করা হয়নি (যদিও দেবী চৌধুরানী ছবিটি সত্যজিৎ রায় সুচিত্রাকে নিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুচিত্রার তখন অনেকগুলো ছবিতে কাজ ছিল বলে শিডিউল দিতে পারেননি। সত্যজিৎ পরে আর ছবিটি নির্মাণ করেননি)। নিঃসন্দেহে সুচিত্রা সেন অনেক বড় মাপের অভিনয়শিল্পী। আমরা দেখেছি, উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পর সাত-দশ বছর পর্যন্ত কলকাতার চলচ্চিত্রশিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল। এরপর প্রসেনজিৎ, তাপস পালরা চলচ্চিত্রশিল্পটাকে টেনে টেনে ওপরে তুলেছেন। উত্তমবিহীন চলচ্চিত্রশিল্প বন্ধ হয়ে যেতে লেগেছিল, কিন্তু সুচিত্রাবিহীন চলচ্চিত্রশিল্পে কোনো প্রভাবই পড়েনি। সুচিত্রার পর অনেক নায়িকাই ভালোভাবেই নিজেদের মেলে ধরেছেন।
আজকে সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর পর আমাদের দেশের টিভি-চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকায় দারুণ হইচই হচ্ছে। কিন্তু কলকাতার কোনো টিভি চ্যানেল কিংবা পত্রিকায় ততটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে না। আমি খুবই দুঃখের সঙ্গে বলছি, সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর পর কলকাতা টিভি চ্যানেলগুলো সেভাবে কোনো কিছুই করল না। শুধু দেখলাম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতা। আর দেখলাম হাতেগোনা কয়েকজন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট মানুষের উপস্থিতি ও কিছু গণ্যমান্য মানুষের শোক প্রকাশ। সুচিত্রা সেন পাবনার মেয়ে এবং গেন্ডারিয়ায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় আমাদের দেশের মিডিয়াগুলোর মধ্যে একটা আলাদা আবেগ কাজ করেছে, যা কলকাতায় বলা যায় উপেক্ষিতই।
সুচিত্রা সেন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই কিন্তু সুচিত্রা সেন হয়েছেন। তার পরও তিনি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রশিল্পকে বঞ্চিত করেছেন। ভক্ত-শ্রোতা থেকে শুরু করে সব ধরনের সংবাদমাধ্যম থেকে আড়ালে রেখেছেন নিজেকে। আমি মনে করি, একজন অভিনয়শিল্পী যখন তাঁর শিল্পের সঙ্গে আমরণ কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকবেন, তখনই তাঁকে মহানায়ক কিংবা মহানায়িকা বলার বিষয়টি সামনে আসবে। নতুবা নয়।
আমি বলতে চাই, সুচিত্রা সেন স্বার্থপর। তিনি নিজেকে একজন রূপবতী নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন এবং রূপবতী হয়েই সবার মাঝে থাকতে চেয়েছেন। আর এ জন্যই তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। কারও সঙ্গেই দেখা করেননি।
তিনি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের এভাবে বঞ্চিত না করলেই পারতেন।
৬০ ও ৭০ দশকে ঢাকার ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক
অনুলিখন: মনজুর কাদের