কোথায় গেল গানের অ্যালবাম

হায়, কোথায় গেল সেই দিনগুলো! রাজধানীর নবাবপুর, পাটুয়াটুলীর গানের বাজার কি এবার চিরশান্তির পথে? নাকি দূরের কোনো দ্বীপে নির্বাসনে গেছে? কোথায় সেই দিনগুলো, যখন শত শত অ্যালবামে হাজার হাজার গান প্রতিযোগিতায় মেতে উঠত? হাটে-মাঠে, পথে-প্রান্তরে, মুখে মুখে নতুন নতুন গান বাজত।

সেই দিনগুলো, যখন ঈদের জামা-জুতোর সঙ্গে সমানতালে কেনা হতো নতুন গানের ক্যাসেট, সিডি। এখন ঈদ আছে, গান নেই। ঈদ আসে, ঈদ যায়, নতুন বছর আসে, যায়। শীতের ছুটি হয়। বসন্তের রং মেখে উৎসবে মাতে তরুণ-তরুণী। গোলাপ, শাড়ি, টি-শার্ট বিক্রি হয়। শহরের ক্যাসেটের দোকানগুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে। গানের বাজারে আর ‘হিট’ তকমা লাগে না।

ইউটিউব, আইটিউনস, ইন্টারনেটের যুগে গানের সিডি বাজারে বিক্রি হয় না—এমনটাই বলছেন বিনিয়োগকারীরা। মন্দা বাজারের কারণে অনেকগুলো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সাউন্ডটেক, সংগীতা, সিএমভির মতো কিছু প্রতিষ্ঠান পুরোনো ঠিকানা বদলে নতুন ঠিকানায় ছোট পরিসরে ব্যবসা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়। সবার কথা একটা জায়গায় মিলে যায়—‘এখন আর আগের মতো চলে না।’

সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, মমতাজ, শুভ্র দেব, সামিনা চৌধুরী, বেবী নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী, কনকচাঁপা, আঁখি আলমগীরেরা গত তিন দশকে নতুন গান দিয়ে গানের বাজারে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। এ তালিকায় বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ কিংবা নবীন এমন কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে আছেন বাপ্পা মজুমদার, আসিফ আকবর, মনির খান, এস ডি রুবেল, আতিক হাসান, মেহরিন, কানিজ সূর্বনা, তিশমা, তাহসান, হাবীব, বালাম, কণা, মিলা, ন্যান্‌সি প্রমুখ। ব্যান্ড সোলস, মাইলস, রেনেসাঁ, ফিডব্যাক, এলআরবি, নগরবাউল, প্রমিথিউস, দলছুটসহ এককভাবে ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, বিপ্লবদের একক অ্যালবামও বাজারে ধুন্ধুমার বিক্রি হতো। এসব ব্যান্ড, তারকার নতুন গানের জন্য অপেক্ষা করতেন শ্রোতারা।

গত দুই বছরে জনপ্রিয় শিল্পীদের বেশির ভাগই কোনো একক অ্যালবাম করেননি। হয়নি জনপ্রিয় শিল্পীদের নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো মিশ্র অ্যালবাম। ব্যান্ড অ্যালবাম সংখ্যাটা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

কারণ কী? বাজার মন্দা! মানুষ কি তাহলে গান শোনা ছেড়ে দিয়েছে?

মোহাম্মদ নোমান ২০ বছর ধরে মৌচাক আনারকলি মার্কেটে অডিও ভিডিও সিডি ক্যাসেট বিক্রি করছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এ ব্যবসায়ী বলেন, আগে এই এলাকায় অন্তত ১২টি দোকান ছিল, যারা সিডি ক্যাসেট বিক্রি করত। এখন মার্কেটের ভেতরে একটি দোকান অবশিষ্ট আছে। তিনি জানান, দীর্ঘদিন মন্দা পরিস্থিতি নিয়েও কষ্ট করে সিডি বিক্রি চালিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি ‘সিডি নেট’ নামের সেই দোকানে জামাকাপড় বিক্রি শুরু করেছেন। দোকানের সিডি প্লেয়ারে নিজেই পুরোনো গানগুলো শোনেন। আর স্মৃতিচারণা করেন।

এখনো পুরোনো সিডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে, রাজধানীর এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানালেন, বিগত এক বছর এমন কোনো অ্যালবাম বের হয়নি যা ক্রেতারা দোকানে খুঁজছেন, কিনছেন।

স্কুল-কলেজের টিফিন বা সংসার খরচে কাটছাঁট করে নতুন অ্যালবাম সংগ্রহ করতেন যাঁরা, সিডি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও হারিয়ে যাওয়া মানুষ হয়ে উঠছেন, এমনটাই মনে করছেন রেনেসাঁ ব্যান্ডের শিল্পী নকীব খান।

সিনেমায় গান করে জনপ্রিয়তা পাওয়া শিল্পী এন্ড্রু কিশোর মনে করেন যুগের বিবর্তন বা পরিবর্তনের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। লোকজনের গান শোনার অভ্যাস পাল্টেছে। ‘ফিরে ফিরে আসি’র মতো রেকর্ড করা এ শিল্পী বললেন, ‘আমি পেশাদার শিল্পী। প্রযোজকেরা না চাইলে নিজের উদ্যোগে অ্যালবাম করার মানসিক অবস্থা নেই। আমরা কাজ করছি না ঠিকই কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাবীব, হৃদয় খান, প্রীতমের মতো তরুণেরা এই জায়গাটাতে নিয়মিত কাজ করছেন।’

অ্যালবাম প্রকাশে এত দ্বিধা কেন? প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম বললেন, ‘যে টাকা বিনিয়োগ করে সিডি তৈরি হচ্ছে, বিক্রিবাট্টার মাধ্যমে তার অর্ধেক টাকাও ঘরে আসছে না। অনুমোদিত সাইট থেকে মানুষ বিনে পয়সায় গান ডাউনলোড করে শুনছে। তাহলে কোন ভরসায় আমরা সিডি অ্যালবামে অর্থ লগ্নি করব?’ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেকের স্বত্বাধিকারী সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা নতুন সিডি প্রকাশ করার আগে তার বিক্রির দিকটা খুব সতর্ক হয়ে বিচার করছি। ইতিমধ্যেই আমরা ডিজিটাল মিউজিক প্রকাশ করাও শুরু করেছি।’

মমতাজ

গেল দশকে উৎসব-পার্বণসহ নানা সময়ে যে কয়জন শিল্পীর নতুন অ্যালবামের চাহিদা বাজারে বেশি থাকত, আসিফ আকবর তাঁদের অন্যতম। জনপ্রিয় এই শিল্পীর নতুন কোনো অ্যালবাম গেল ঈদে বাজারে ছিল না। অবশ্য অনলাইনে তাঁর বেশ কিছু গান পেয়েছে শ্রোতারা। আসিফের মতে, ‘এই ডিজিটাল যুগে ১০ গান দিয়ে সিডি অ্যালবাম করাটা অযৌক্তিক। এখন তো সিডি চালানোর প্লেয়ারই পাওয়া মুশকিল!’

একটু ভিন্ন মত দিলেন সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। ৯০ দশকে গানের সুর করেই তারকাখ্যাতি পাওয়া এই সুরকার বিগত কয়েক বছরে প্রকাশিত কেয়া পাতার নৌকো, খেয়াল পোকা-এর মতো কিছু অ্যালবামের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এখনো আমি অ্যালবাম করে সাড়া পাচ্ছি এবং পেশাদার শিল্পী হিসেবেই কাজ করছি।’

প্রিন্স মাহমুদ মনে করেন, এখন অনলাইনের যুগ চলে এলেও এখনো তরুণেরা নতুন গানের অ্যালবাম খোঁজেন। গুণী শিল্পী শুভ্র দেব ২০১৪ সালে প্রকাশিত জলছবি অ্যালবামের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘ওই অ্যালবামের সিডি বেশ ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। যাঁরা মূলত গান ভালোবাসেন, তাঁরা ঠিকই কেনেন, সংগ্রহ করে রাখেন। এর একটা আর্কাইভাল ভ্যালু আছে।’

বটে। এটা ঠিক যে কালেভদ্রে একটা-দুটো করে গান আলোচনায় আসে। মানুষ খোঁজে।

কিন্তু আগে যেখানে একটি অ্যালবামে ১০ থেকে ১২টি গান বের হতো, অন্তত ৪-৫টি গান আলোচনায় আসত, এখন সে রকম হচ্ছে না। ৫টি গান দিয়ে একটি অ্যালবাম কিংবা ১ গানের একটি অ্যালবাম বাজারে আসছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন গীতিকার আসিফ ইকবাল।

যিনি নিজে গানের বাজারের একজন উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, এখন মানুষের হাতে এত সময় নেই যে একসঙ্গে বসে ১০টি গান শুনবে। তাই বলে মানুষ গান শোনা ছেড়ে দিয়েছে, তা নয়। তবে এখন বাজারের ধরনটা বদলে গেছে। আগে ছিল শিল্পী পরিচালিত বাজার। শিল্পীরা যে গানটি দিতেন, শ্রোতারা সেটা নিত বা নিতে বাধ্য হতো। এখন সেটা সম্পূর্ণ ভোক্তা তথা শ্রোতার পরিচালিত বাজার হয়েছে। শ্রোতার হাতের মোবাইলে কিংবা পিসিতে কোন গানটা শুনবেন, সেটা তিনি নিজেই ঠিক করবেন। মাল্টিচয়েস থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ তাঁর আছে।’

এভাবে বদলে যায় বাজার। পাল্টে যায় গান শোনার অভ্যাস। ১০ গানের সিডি অ্যালবাম কমতে কমতে ১ গানে এসে ঠেকে। রাস্তায় যানজটে আটকে গেলে চালক আর ক্যাসেট বা সিডির বক্স খোঁজেন না। মোবাইলের সঙ্গে শব্দযন্ত্রের সংযোগ করে একের পর এক দেশ-বিদেশের গান শোনেন। গান শোনেন ইন্টারনেটে, আইটিউনসে, ইউটিউবে। কোনো গান ভালো না লাগলে টুক করে অন্য গানে চলে যান। কারণ, বাজারটা এখন তাঁর হাতে।

ড্রয়িংরুমে বুকশেলফে সাজানো কিছু রচনাবলির সঙ্গে গ্রামোফোন আর লং প্লে দিয়ে ঘর সাজানোর প্রচলন দীর্ঘদিনের। কে জানে এরপর সিডিও হয়তো মিলবে শুধু গুলশান কিংবা শাহবাগের অ্যান্টিকস শপে!