চড়াই-উতরাইয়ের পর দর্শকের সামনে 'পঞ্চসঙ্গী'
‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র পর ছিল একটা দীর্ঘ বিরতি। মধ্যে ‘দীপু নম্বর টু’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’সহ শিশু-কিশোরদের জন্য তৈরি হয়েছে হাতে গোনা অল্প কিছু চলচ্চিত্র। এবার মুক্তি পাচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘পঞ্চসঙ্গী’।
কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের উপন্যাসকেই চলচ্চিত্রের বড় পর্দায় সাজিয়েছেন ছেলে জাঁ-নেসার ওসমান। আজ শনিবার সকালে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ছবিটির প্রিমিয়ার হয়। কাজ শুরুর দীর্ঘদিন পর দর্শকের সামনে এল ছবিটি। অথচ পরিচালকের মন ভার, ছবিটি নিতে চাইছে না কোনো হল। কারণ, অনুদানের এই ছবিতে নেই কোনো আইটেম সং, নেই কোনো মার মার কাট কাট অ্যাকশন। আজ ছবি দেখে কয়েকজন দর্শক এমনও বলেছেন, শেষটা একটু খাপছাড়া লাগছে। কারণ হিসেবে পরিচালক নিজেই অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা ছাড়া সেন্সর বোর্ড শেষ দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য ফেলে দিয়েছে। যার ফলে শেষটা একটু খাপছাড়া লাগছে।
আজ সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ‘পঞ্চসঙ্গী’র প্রিমিয়ারে উপস্থিত ছিলেন ছবির পরিচালক জাঁ-নেসার ওসমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সদস্যসচিব ফরিদ মাহমুদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, যুগে যুগে দেশকে ভালোবাসতে হলে, স্বনির্ভর রাখতে গেলে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে ‘পঞ্চসঙ্গী’ সিনেমাটি একটি পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে। অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের নতুন প্রজন্ম যদি “পঞ্চসঙ্গী”র মতো শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখে বড় হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দুষ্টু লোকেরা শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিকৃত ইতিহাস গেঁথে দিতে পারবে না।’ লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘পঞ্চসঙ্গী’ চলচ্চিত্রটি নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নাড়া দেয়। এই চলচ্চিত্রটি বারবার শিশু-কিশোরদের দেখাতে হবে।
পিতার উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নির্মাতা জাঁ-নেসার ওসমান ‘পঞ্চসঙ্গী’র জন্য সরকারের অনুদান নিয়েছেন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। তারপর থেকে প্রিমিয়ার পর্যন্ত আসা শিশুতোষ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ হওয়ার পেছনেও রয়েছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের গল্প। এত বছর কেন লাগল? নির্মাতা জাঁ-নেসার ওসমান জানালেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘পঞ্চসঙ্গী’সহ মোট ১০টি ছবি অনুদান প্রাপ্তির জন্য প্রতিযোগিতা করেছিল। তখন শিশুতোষ চলচ্চিত্র শাখা ও অন্যান্য বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল ‘পঞ্চসঙ্গী’ ছবির চিত্রনাট্যটি। জাঁ-নেসার ওসমান বলেন, ‘যেহেতু আমার ছবিটি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল, সেহেতু ধরেই নিয়েছিলাম “পঞ্চসঙ্গী” অনুদান পাবে। কিন্তু এটি তো অনুদান পেলই না, উল্টো যে ছবিগুলো তালিকার নয়, ১০ নম্বরে ছিল, সেগুলোই অনুদান পেল।’ ‘পঞ্চসঙ্গী’ ছবিটিকে অনুদান না দেওয়ার পক্ষে কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, ‘জননী’ নামের একটি অনুদানপ্রাপ্ত ছবির কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারেননি জাঁ-নেসার ওসমান। এ প্রসঙ্গে জাঁ-নেসার ওসমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘“জননী” ছবি শেষ করতে না পারার অন্যতম কারণই ছিল ছবিটির জন্য ঘোষিত অর্থের একটি টাকাও তৎকালীন কর্তৃপক্ষ আমাকে দেয়নি। ফলে প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমিও আর এগোতে পারিনি।’ অবশ্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছবিটি শেষ পর্যন্ত সরকারি অনুদান পায় এবং এরপরই সেটির কাজ শেষ হয়।
ছবিটির সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিছু দৃশ্য নিয়ে আপত্তি ছিল। অবশেষে মুক্তি পেয়েছে কিছু দৃশ্য কাটছাঁট করে। পরিচালক বললেন, ‘কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য ফেলে দেওয়ার কারণে দর্শকের কারও কারও কাছে শেষটা একটু খাপছাড়া লাগছে। আমরা সেন্সর বোর্ডে আবার আবেদন করব। যুক্তিযুক্ত দৃশ্যগুলো আবার যোগ করার চেষ্টা করব।’
বংশীর বাপ, বেলাল, মলয়, জহুর ও ফেলানী নামে ১০-১২ বছর বয়সী পাঁচ কিশোর চরিত্রকে ঘিরে প্রধানত এগিয়ে চলে শিশুতোষ এই চলচ্চিত্রের আখ্যান। গল্পের পটভূমি ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠতে থাকা গণজাগরণের ঘটনাগুলোই পাঁচ ছিন্নমূল এই কিশোর-কিশোরীর চোখে চিত্রিত হয়। এই কিশোরদের আত্মজ্ঞানেই ধরা দেয় পাকিস্তানিদের বর্বরতা, অমানবিকতা। তবে এই গল্পের মধ্যেও ব্রিটিশ শাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ তৈরিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, তৎকালীন সমাজে বিহারি-বাঙালিদের মধ্যকার বৈষম্যসহ নানা গল্প উঠে আসে। যদিও গল্পের শেষ হয় ’৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাদের গুলির আঘাতে এই কিশোরদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায়, ঢাকার কিছু পথশিশু বই বিক্রি করছে। এ সময় এক ভদ্রমহিলা পথশিশুদের কথাশিল্পী শওকত ওসমান রচিত কিশোর উপন্যাস ‘পঞ্চসঙ্গী’ কিনে দেন। তাদের মধ্যে প্রতাপ পড়তে পারে। তখন প্রতাপ বই পড়া শুরু করে আর ওরা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে কল্পনায় মিশে যায়, এ যেন ওদেরই জীবন।
সিনেমা হলে না মুক্তি পেলে ছবিটি কীভাবে মানুষ দেখতে পাবে? এ প্রশ্নের জবাবে নির্মাতা জানান, তিনি চেষ্টা করছেন ঢাকার বাইরে দু-একটা হলে মুক্তি দেওয়ার। যোগাযোগ করছেন। আর যা-ই হোক, চট্টগ্রামের অন্তত একটি সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়ার ইচ্ছা আছে। চট্টগ্রাম পরিচালকের জন্মস্থান, এ কারণে এই শহরের প্রতি দুর্বলতা আছে তাঁর। তিনি আরও জানিয়েছেন, তিনি চেষ্টা করছেন শিল্পকলা, শিশু একাডেমি মিলনায়তনে ছবিটি প্রদর্শনের। পাশাপাশি ছবিটি যাতে দেশের সব শিশু প্রেক্ষাগ্রহে গিয়ে দেখতে পারে, সে জন্য তিনি সরকারের কাছে এর কর মওকুফের আবেদন করবেন। ফলে আশা করা যেতেই পারে, এই ছবির বদৌলতে শিশুতোষ ছবি নির্মাণে আবার জোয়ার আসবে।