ছু মন্তর ছুহ!

জুয়েল আইচ, পি সি সরকার. হ্যারি হুডিনি, ডেভিড কপারফিল্ড
জুয়েল আইচ, পি সি সরকার. হ্যারি হুডিনি, ডেভিড কপারফিল্ড

জাদু বা ম্যাজিকের মন্ত্র এটা। বহু আগে ম্যাজিক বা জাদু ছিল ব্ল্যাক আর্ট। জাদুটোনা। অন্যের ক্ষতি করার অতীন্দ্রিয় কৌশল। পরে জাদু হয় শিল্প। আর্ট। ক্ষতির জন্য না, বিনোদনের জন্য। গত শতকে জাদু ছিল বিনোদনের বড় মাধ্যম। টিভি ম্যাগাজিন বা বিনোদন অনুষ্ঠানের মজার জাদু ছাড়া ছিল অপূর্ণ। আর একক জাদু বা ‘ম্যাজিক শো’ ছিল জনপ্রিয় ইভেন্ট। শোগুলো হতো বড় বড় অডিটোরিয়াম বা খোলা আকাশে। জাদুশিল্পীকে মানুষ ডাকত জাদুকর। জাদুকরদের অনেকে ‘অতিমানব’ ভাবত। সাধারণের কাছে তাঁরা অসাধারণ। সুপারম্যান। এ রকমই একজন সুপারম্যান ছিলেন ভারতের জাদুকর পি সি সরকার।

পি সি সরকার মানে প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার। ভারতীয় হলেও জন্মেছিলেন আমাদের টাঙ্গাইলে। গত শতকের ৫০ ও ৬০-এর দশকে বিশ্ব কাঁপানো জাদুকর। অসম্ভবকে সম্ভব করাই ছিল পি সি সরকারের কাজ। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। এক জাদুর শোতে পি সি সরকার দুই ঘণ্টা দেরি করে এসেছেন। দর্শকেরা খেপে বোম। কেন এত দেরি? পিসি সরকার সবাইকে শান্ত হতে বলে বললেন, তিনি দেরি করে আসেননি। সবাই আরও খেপে তাঁকে মিথ্যাবাদী ডেকে বলল, সন্ধ্যা চারটার জায়গায় তিনি রাত আটটায় এসেছেন, আবার বলেন দেরি করে আসেননি! তিনি আবারও দাবি করলেন, তিনি ঠিক সময়ই এসেছেন। সবাইকে আরেকবার ঘড়ি দেখতে বললেন। ঘড়ি দেখে সবাই টাশকি। চোখ বড় বড়। সবার ঘড়িতে ছয়টা বাজে! পিসি সরকার ঠিক সময়ই এসেছেন!

এ রকম সব বড় বড় আজব মজার ম্যাজিশিয়ান ছিলেন পি সি সরকার। জীবিত মানুষের শরীর কয়েক ভাগ করে আবার জোড়া লাগিয়ে দিতেন। জোড়া লাগানো মানুষ উঠে হেঁটে চলে যেত। সবার সামনে আস্ত মানুষ উধাও করে দিতেন। এক কথায় বিশ্ব কাঁপানো সুপারম্যান।

সিঙ্গাপুর পলিটেকনিক অডিটোরিয়ামে মেয়ে খেয়াকে নিয়ে ‘বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের জাদু’ দেখান জুয়েল আইচ

বাসায় এ রকম আরেক সুপারম্যানের দেখা পাই যখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি। মফস্বল শহর থেকে আসা আমার এক ফুপাতো ভাই। এমএ পাস করে চাকরির আশায় বড় কর্তা আব্বা মানে, তার মামার বাসায় বেড়াতে এসেছে। বাসায় গান শোনে, বাজার করে, সিগারেট ফুঁকে আর আমাকে জাদু দেখায়। আজব সব জাদু! দড়ি কেটে জোড়া লাগানো, ম্যাচের বাক্সের নানা কারসাজি আর তাসের সব ম্যাজিক দেখে আমি তাজ্জব। এক সন্ধ্যায় আরও তাজ্জব হই ড্রয়িং রুমে হুলুস্থুল দেখে। কোথা থেকে যেন এক ম্যাজিশিয়ান বাসায় এসেছেন। প্রজেক্টের অফিসার্স ক্লাবে পরের সন্ধ্যায় তাঁর ম্যাজিক শো হবে। অলটাইম বিনোদনের উদ্যোক্তা আব্বার সঙ্গে বসে চা খাচ্ছেন। ছোট্ট আমি মুখে আঙুলে অবাক হয়ে দেখছি তাঁকে। একজন ‘অতিমানব’ পিরিচে চা ঢেলে চুক চুক করে খাচ্ছেন।

পরের সন্ধ্যায় ক্লাবে গোলাপি পাগড়িতে তাঁর যে ম্যাজিকটি আমাকে অবাক করে, তা হলো ‘সোনার বালা ও কাঠগোলাপ’। দর্শক সারিতে বসা আম্মার কাছ থেকে হাতের একটা সোনার বালা চেয়ে নেন জাদুকর। রুমালে মুড়ে ‘ও-স্তা-দ পি-সি স-র-কা-র’ বলে চিৎকার দিয়ে বাতাসে ছুড়ে দিলেন বালা! বালা হয়ে গেল কাঠগোলাপ। আম্মার মুখ গেল শুকিয়ে। আর জাদুকর কাঠগোলাপটি সবার নাকের সামনে ধরছেন। শুঁকিয়ে রায় নিচ্ছেন তা অরিজিনাল কি না। কী আজব! এ তো আমাদের বাসার ব্যাক ইয়ার্ডের গাছের কাঠগোলাপ। এ অঞ্চলে একটাই আছে। এবার জাদুসম্রাট আবার কাঠগোলাপকে রুমালে মুড়িয়ে হাতের তালুতে নিয়ে ‘ও-স্তা-দ পি-সি স-র-কা-র’ বলে দিলেন হাতুড়ির এক বাড়ি। টং করে শব্দ হলো। রুমালে কাঠগোলাপের বদলে বেরিয়ে এল উড়ে যাওয়া সোনার বালা। আম্মাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হাতে পরে দেখেন, ঠিক আছে কি না।’ আম্মা শুকনো মুখে মাথা নাড়িয়ে বললেন ঠিক আছে। সবার তালি। বালায় কাঠগোলাপের ঘ্রাণ। আম্মা পুরোপুরি নিশ্চিত নন, আসল সোনার বালাটিই ফেরত পেয়েছেন কি না। মাঝে মাঝেই হাত বুলিয়ে বালাটি দেখছেন। তাঁর কাছে তো তখন সোনার ক্যারেট মাপার যন্ত্র ছিল না।

এই গ্রহে আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে প্রথম পেশাদার জাদুকর হিসেবে আলোড়ন তোলেন ১৮৯০ সালে এক মার্কিন জাদুকর। নাম হ্যারি হুডিনি। জাদু বিনোদন নিয়ে লাইমলাইটে আসেন। আজব জাদুকর হুডিনি। প্রথম প্রথম তাসের জাদুতে মাতালেও হুডিনি জনপ্রিয় হন তাঁর ‘তালাবদ্ধ থেকে উধাও’ জাদুতে। হুডিনিকে চেইন-তালা দিয়ে লকারে ভরে রাখলেও পালিয়ে যান তিনি। একবার পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করায় পুলিশ তাঁকে চেইনে বেঁধে সেলে ঢুকিয়ে চারদিক ঘিরে রাখে। চারিদিকে দর্শক। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান হুডিনি। সেল ফাঁকা!

হুডিনি এই জাদুকে আরও জনপ্রিয় করেন। দুধের বড় ড্রামে পানি ভরে তার ভেতরে তালাবদ্ধ অবস্থায় ঢোকেন। মুখ আটকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন হুডিনি!

পি সি সরকার



এবার হুডিনির আসল মজার কথা বলি। ভালো লাগবে। গ্যারান্টেড।

শত শত বছর আগে আমাদের এই দেশকে পশ্চিমারা বলত ইন্দ্রজালের দেশ, জাদুর দেশ। আমাদের দেশ তারা শাসন করায় তাদের মাধ্যমে পশ্চিমে ছড়িয়ে যায় আমাদের দেশের পথে পথে সাপের খেলা আর ভয়াবহ জাদুর কথা। বিশ্ব কাঁপানো হুডিনিও জানতেন আমাদের চিপা গলির ওস্তাদ জাদুকরদের খবর। তাই স্টেজ শো করার সময় সাদা চামড়ায় কালো রং মেখে হুডিনি আমাদের বাদামি রং নিতেন। শোতে তাঁর ছদ্মনাম থাকত ‘ফকির চাঁদ’, আমাদের ‘পথজাদুকর’দের সম্মান করে! সেই সময়ের কথা বলছি।

হুডিনি মারা যান তালাবদ্ধ জাদু দেখাতে গিয়েই। একবার ডুবন্ত অবস্থায় তালা খুলতে পারেননি। দম বন্ধ হয়ে দুঃখজনক ভাবে মারা যান লিজেন্ড জাদুকর হ্যারি হুডিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে শৈল্পিক জাদুকর হিসেবে আবির্ভূত হন জুয়েল আইচ। কথা বলেন চমৎকার, হাসেন সুন্দর, বাঁশি বাজান মোহনীয় সুরে। একজন জাদুশিল্পীর এসব গুণ থাকতে হয়। জুয়েল আইচ তাঁর তীক্ষ্ণ সমন্বয় ঘটান। হয়ে যান উপমহাদেশের সেরা জাদুকর। পি সি সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। বাঁশি বাজাতে বাজাতে উঠে যান বাতাসে, হাসতে হাসতে সুন্দরী মেয়েকে তিন ভাগে আলাদা করে আবার জোড়া লাগান, বাতাসে ভাসিয়ে দেন শুয়ে থাকা মেয়েকে। হুডিনির মতো তালাবদ্ধ অবস্থা থেকে জুয়েল আইচও বেরিয়ে আসেন। তবে পানির পাত্র থেকে না, সিন্দুকের ভেতর থেকে।

জুয়েল আইচের একটা মজার ঘটনা। বহু বহু বছর আগের। শো করতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। বিমানবন্দরে বিশেষ কারণে বসে আছেন। ডলারের প্রসঙ্গে তিনি এক অফিসারকে বলেন, তাঁর ডলার দরকার হয় না, তিনি জাদুকর, কাগজকেই তিনি ডলার বানাতে পারেন। শুনে অফিসার তাঁকে দেখাতে বলেন। জুয়েল আইচ অফিসারের কাছ থেকে এক টুকরা সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে মুহূর্তে কাগজটিকে ১০০ ডলার বানিয়ে ফেলেন! সারা এয়ারপোর্টে হইচই পড়ে যায়। সব্বোনাশ, এই জাদুকর তো আমেরিকার সব কাগজকে ডলার বানিয়ে ফেলবে!

হ্যারি হুডিনি

আমার ঐতিহাসিক নির্বাক কমেডি সিরিয়াল ‘ভোলার ডায়রি’তে জাদু নিয়ে মজার তিনটা পর্ব বানিয়েছিলাম। স্ক্রিপ্ট লিখে মুশকিলে পড়লাম। জাদুকর লাগবে এ জাদু দেখাতে। এর মধ্যে মানুষ কেটে জোড়া লাগানো জাদুও আছে। জাদুকর শাহীন শাহকে প্রফেশনালি অ্যাপ্রোচ করলাম। কিন্তু বড় সমস্যা হলো, শুটিং করতে গেলে আমাকে আর মূল অভিনেত্রীকে জাদুর গোপন কথা জানতেই হবে। শাহীন শাহ আমাকে আর অভিনেত্রীকে আলাদা ঘরে নিয়ে কিরা-কসম কাটিয়ে জাদুর গুমর ফাঁস করলেন। শুটিংয়ে নায়িকা নায়ককে দুই টুকরা করে বাঁচিয়ে তুলল। জাদুটি এখন আমি পারি। খু-ব সোজা, কিন্তু বলব না।

ইতিহাসে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল জাদুকর যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড কপারফিল্ড। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ঢ্যাঙা লম্বা জাদুকর। লিভিং লিজেন্ড। সারা বিশ্বে তুখোড় জনপ্রিয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ম্যাজিক শুরু করে দেন। এতটাই জনপ্রিয় হন যে, ২১ বছর বয়সেই এবিসি টিভি তাঁকে দিয়ে জাদুর অনুষ্ঠান করায়। সিবিএস টিভিতেও লাগাতার জাদু অনুষ্ঠান করেন। এ পর্যন্ত জাদুর ওপর ১৭টি টিভি অনুষ্ঠান করেছেন ডেভিড কপারফিল্ড! জাদুকর চরিত্রে মুভিতে অভিনয় করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর জাদু প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষ ৪ বিলিয়ন ডলারের টিকিট কেটে দেখেছে। এখন পর্যন্ত শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোনো একক শিল্পীর এটাই রেকর্ড। জীবনে পুরস্কার পেয়েছেন বহু। এমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য ৪০ বার মনোনীত হয়ে ২১ বারই জিতেছেন। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ১১ বার নাম আছে তাঁর। ফ্রান্স সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দিয়েছে।

ডেভিড কপারফিল্ডের ভয়াবহ জনপ্রিয়তার কারণ, জাদুতে তিনি নতুন চমক এনেছেন। সবার সামনে উধাও করে দেন আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি! পরে আবার বসিয়ে দেন। বিশাল উপত্যকার এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে চলে যান বাতাসে ভেসে! যে চীনের প্রাচীরের জন্য কোনো দস্যুই চীন আক্রমণ করতে পারেনি, তিনি হাজার মানুষের সামনে সেই প্রাচীর ভেদ করে চীনে ঢুকে পড়েন। হাওয়া করে দেন যাত্রী বোঝাই আস্ত ট্রেন!

ডেভিড কপারফিল্ড এখন বিশ্ব জাদুর ‘আমির খান’।

ডেভিড কপারফিল্ড



জাদুশিল্প হঠাৎ একটু স্তিমিত হয়ে পড়েছে। অনেকে ডিজিটাল দুনিয়াকে এর জন্য কিছুটা দায়ী করলেও বেশির ভাগ মানুষ তা মানতে নারাজ। আশাবাদীরা বলেন, যদি তা-ই হতো, তাহলে যুগে যুগে হ্যারি হুডিনি, পিসি সরকার, জুয়েল আইচ, ডেভিড কপারফিল্ডরা আসতেন না। যদি ডিজিটাল দুনিয়া মানুষের বাস্তব জগতের সবকিছুই কেড়ে নিতে পারত, তবে মানুষ এখন অ্যানিমেটেড ফুটবল দেখত, বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য চার বছর অপেক্ষা করত না। হুডিনি তো মানুষের চাঁদ বিজয়ই দেখেননি, আর ডেভিড কপারফিল্ডের ফেসবুক আইডি আছে।

ছোটবেলায় এক টিভি সিরিয়াল দেখেছিলাম ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’ নামে। বিল বিক্সবি অভিনীত। সিরিয়ালে ম্যাজিশিয়ান একজন উপকারী মানুষ। দুর্যোগে ম্যাজিশিয়ান হাজির হন। ম্যাজিক করে দুর্যোগ কাটিয়ে দেন।

বোদ্ধারা বলেন, জাদুশিল্পের যদি দুর্যোগ নেমে আসে, হুট করে হাজির হয়ে যাবে নতুন কোনো ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’। বলবে, ছু মন্তর ছুহ! উধাও হয়ে যাবে দুর্যোগ। উধাও করা আর ফিরিয়ে আনাই তো জাদুকরের কাজ।