এখন তাঁরা তারকা দম্পতি, কিন্তু বিয়ের আগে কিংবা তারকা হওয়ার আগে কেমন ছিল তাঁদের ঈদ-উদ্যাপন? তারকা দম্পতিদের মুখে শুনুন তাঁদের এখনকার আর তখনকার ঈদের কথা

তারকা দম্পতির ঈদ

তৌকীর-বিপাশা
তৌকীর-বিপাশা

তৌকীর-বিপাশা
পড়াশোনার বিষয়ে দুজন দুই মেরুতে। একজনের হাতে রং তুলি, পাশে ক্যানভাস। অন্যজনের হাতে পেনসিল, টেবিলে স্থাপত্য নির্মাণের নকশা। কিন্তু শিল্পের অন্য এক জগতে দুজনই এক—‘তারকা’। তারপর দুজন আবার দুজনার জীবনসঙ্গী—তারকা দম্পতি। বলছিলাম তারকা দম্পতি তৌকীর আহমেদ ও বিপাশা হায়াতের কথা। শুটিং চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে—ঈদের নাটকের শুটিং। অনেক দিন পর দুজন একসঙ্গে অভিনয় করছেন। শুটিংয়ের এক ফাঁকে আলাপ বিপাশার সঙ্গে। তারকাখ্যাতির আগে ঈদের আনন্দটা কেমন ছিল?
এমন প্রশ্নে বিপাশার মুখে মৃদু হাসি। তৌকীর ওই মুহূর্তে পাশে নেই। ‘ঈদের আনন্দ আসলে একেক বয়সে একেক রকম। যেমন শৈশবে আমার ঈদের আনন্দটা ছিল নতুন জামাকে ঘিরে। নিজের নতুন জামাটি হতে হবে সবার থেকে আলাদা। খুব যত্নে লুকিয়ে রাখতাম সেই জামা।’ বিপাশা বলছেন তাঁর শৈশবের ঈদের কথা। তবে কৈশোরে এসে বিপাশার ঈদের রং পরিবর্তন হয়ে গেল—নতুন পোশাক ছেড়ে আগ্রহটা চলে গেল বইয়ের দিকে। বই পড়ার আনন্দ বিভোর করে তুলল তাঁকে। ঈদ উপহার হিসেবে তখন সবার কাছ থেকে তিনি আবদার করে বসলেন নতুন বই—সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, আন্তন চেখভের বই, শার্লক হোমস প্রভৃতি। ঈদের দিনে বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় আর খাওয়া দাওয়ার বিষয়টি তো আছেই; বিপাশার ঈদ আনন্দের সবটাই ছিল এসবের মধ্যে।

বিপাশা বলেন, ‘ঈদ কার্ড বানিয়ে জীবনের প্রথম উপার্জন করেছিলাম আমি।’

মানে?

একসময় বাসায় বসে চমৎকার সব ঈদকার্ড বানাতে ওস্তাদ ছিলেন তিনি। বিপাশার বানানো ঈদকার্ড বিক্রি হতো সাগর পাবলিশার্সে।

তারকা হওয়ার পরের বিপাশার ঈদের অভিজ্ঞতা জানা যাক। ‘তারকা হওয়ার পর ঈদের ক্ষেত্রে কোনো রকমফের ঘটেনি। তবে দাম্পত্য জীবনে ঈদের অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন অনুভবের। জীবনে প্রথমবার রান্নাঘরে ঢুকলাম। তারপর ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ঘর গোছানো, পরিবারের সবার প্রিয় খাবারটি রান্না করা...সব মিলিয়ে নতুন এক অভিজ্ঞতা, নতুন ধরনের আনন্দ। জানি না শুনে হাসবেন কি না, তবু একটা কথা বলতে চাই, বিয়ের পর আমার মনে হয়েছে, আমি সামাজিক হয়েছি। এটা অন্য রকম এক জীবনযাপন।’

ওদিকে নাটকের সেট রেডি—পরিচালক বসে আছেন শট নেবেন বলে। বিপাশাকে তাই যেতে হলো শট দেওয়ার জন্য। তৌকীর আহমেদের তখনো দেখা নেই। অগত্যা মুঠোফোনেই আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। তৌকীর আহমেদকেও একই প্রশ্ন—তারকা হওয়ার আগের ঈদ ও পরের ঈদের মধ্যে ফারাক কেমন?

‘ঈদের দিনটিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে অন্য রকম আনন্দে কাটানো যায়। মনে পড়ে, ছোটবেলায় ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। বুকের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করত কখন গোসল করে নতুন জামাটি গায়ে দেব! পরিবারের সবার সঙ্গে যাব ঈদের নামাজ পড়তে। আর নামাজ পড়ে সালাম করলেই তো সালামি পাওয়া যাবে!...সেসব দিন কত সুন্দরই না ছিল!’ বললেন তৌকীর আহমেদ।

ঈদে অনেক টাকা সালামি পেতেন তৌকীর। ঈদের দিনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা এবং টো টো কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে ঘুরে বেড়ানোতে জুড়ি ছিল না তাঁর। বাবার চাকরির সুবাদে থাকতেন সরকারি কোয়ার্টারে। ঈদের দিন সন্ধায় সেখানে আয়োজন করা হতো ঈদ মিলনমেলার। সব মিলিয়ে খুব উৎসবমুখর পরিবেশে কাটত ঈদের দিনটি। অন্যদিকে, অভিনয়জীবনে আসার পর তৌকীরের ঈদের আনন্দটি ছিল আরেকটু অন্যরকম। তিনি বললেন, ‘আমার তারকাখ্যাতির সঙ্গে ঈদের আনন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি মনে করি, জীবনের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই আনন্দ ভিন্নতর রূপ লাভ করে। যখন একা ছিলাম, তখন আনন্দটা সীমাবদ্ধ ছিল কেবল নিজের প্রাপ্তির মধ্যে। তারপর একসময় বড় হওয়া...প্রথম উপার্জন...পরিবারের সবার হাতে কিছু না কিছু উপহার দিতে পারা...বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য প্রথমবারের মতো ঈদের কেনাকাটা...। এরপর প্রথম সন্তানের জন্মের পর তাকে নিয়ে ঈদ করা...। এক জীবনে ঈদের কত না রং! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের আনন্দও সাজতে থাকে নানান রঙের ক্যানভাসে।’

ফারুকী-তিশা

ফারুকী-তিশা


‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’—তাঁরা দুজনই তারকা, কারও চেয়ে কেউ কম নন। তা বলে তাঁদের মধ্যে কি দা-কুমড়া সম্পর্ক? মোটেই সে রকম নয়—বাস্তব জীবনে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী, সুখী দম্পতি। বনানীতে নিজেদের বাড়িতে যতক্ষণ তাঁরা একসঙ্গে থাকেন, ততক্ষণই চলতে থাকে রসের প্রতিযোগিতা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও তিশা—একজন আরেকজনকে রসাল ইট ছুড়ে দিলে ঠিকই অপর প্রান্ত থেকে অন্যজনকে রসের পাটকেলটি খেতে হয়। এই দম্পতির বাসায় বসে তাঁদের কাছে তারকা হওয়ার আগের এবং পরের ঈদ সম্পর্কে কথা পাড়তেই আগেভাগে শুরু করলেন ফারুকী, ‘তারকা হওয়ার আগে-পরের কথা তো বলতে পারব না। তবে ছোটবেলার সঙ্গে বড়বেলার ঈদের পার্থক্য অনেক। ছোটবেলায় ঈদের সময় শিশুপার্কে গিয়ে স্প্রিংবোর্ডের মধ্যে নাচানাচি ও চিড়িয়াখানায় গিয়ে চিড়িয়া দর্শন না করলে ঈদের সার্থকতাই মাটি হয়ে যেত। আর এই বড়বেলায় ঈদের দিন সারা দিন বাসায় বসে থাকি, ঘুমাই। লোকজন দেখতে আসে আমাকে। মনে হয়, আমি নিজেই “চিড়িয়া” হয়ে খানায় বসে আছি। সবাই দেখতে আসছে আমাকে। হা হা হা।’ পাঠক, রসের হাঁড়িটি মাত্র খুলেছেন ফারুকী। তাঁর সহধর্মিণী তিশার কি বসে থাকলে চলে! ‘ ‘ছোটবেলা থেকেই আমি খুব পাকা ছিলাম। ঈদে বড়দের জন্যও কেনাকাটা করতাম। তবে, ছেলেবেলার ঈদগুলোতে আমি কিন্তু ১২-১৩টা জামা পেতাম।’

তিশার কথা মাটিতে পড়তেও পারেনি, অমনি ফারুকী বললেন, ‘এ কথায় তিশা কি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল?’ এরপর তিশার উদ্দেশে আবার তাঁর কথা, ‘আচ্ছা, এই ঈদে তোমাকে ১২-১৩টা পোশাকই দেব।’

সারা ঘর তখন ভরে উঠেছে স্বামী-স্ত্রীর হাসির শব্দে।

ফারুকীকে যেন স্মৃতিতে পেয়ে বসেছে। কারণ, আমরা তাঁর কাছে আবারও জানতে চেয়েছি তাঁর তারকা হওয়ার আগের ঈদগুলো সম্পর্কে।

‘কী বলব, আমাদের নাখালপাড়াতে মহল্লা সংস্কৃতি আছে তো। চাঁদরাতে টের পাওয়া যেত এই সংস্কৃতি। তখন কৈশোর পেরিয়ে কেবল যৌবনে। প্রেম ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। ঈদের চাঁদ ওঠামাত্র যে যার বাড়ির সামনে বড় ডেকসেটে গান বাজাতাম। উদ্দেশ্য এমন ছিল যে আমাদের প্রেমিকারা যেন এই গান শুনতে পায়। তারপর ওই রাতেই মহল্লার বড় ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিতাম। আমরা একে বলতাম “ফিটিং”, সেই টাকা নিয়ে এরপর ছুটে যেতাম এলিফ্যান্ট রোডে। সারা রাত ধরে কেনাকাটা করতাম...। আই মিস ইট, সিম্পলি আই মিস ইট।’

ফারুকীর কথায় স্মৃতিকাতরতা আছে। কিন্তু তিশা কী বলেন তারকাজীবনের ঈদ প্রসঙ্গে?

‘ঈদের কেনাকাটার জন্য গাউছিয়া আমার একটি প্রিয় মার্কেট। তবে এই মার্কেটে আমাকে এখন বোরকা পরে যেতে হয়। তার পরেও কেউ যদি আমায় চিনে ফেলে, তখন আমার খালাতো বোনরাই সহায়।’

কথাটি আরেকটু খুলে বললেন তিশা, ‘আমি যখন গাউছিয়ায় যাই, সঙ্গে থাকে খালাতো বোনেরা। বোরকা পরার পরেও কেউ যদি আমাকে চিনতে পেরে বলে, এটা তিশা না? সঙ্গে সঙ্গে আমার খালাতো বোনদের উত্তর, ‘না না, কী আবোল-তাবোল বলছেন!’

তবে ফারুকী-তিশার ঈদ নতুন রং পেয়েছে দুজন-দুজনার হওয়ার পর। তিশা বললেন, ‘স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর—সবাইকে নিয়ে ঈদ করার মজাই আলাদা।’

আর ফারুকীর কণ্ঠেও তিশাবন্দনা। তবে সেখানে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি অভিযোগও মূর্তিমান, ‘গরুর মাংস আমার খুব প্রিয়। কিন্তু আমার গ্যাসট্রিকের সমস্যার জন্য তিশা আমাকে এখন গরুর মাংস খেতে দেয় না। এই ঈদে কি দেবে?’

ফারুকীর এই আবদারে তিশার মুখে এক টুকরা হাসি খেলা করে।

তাহসান-মিথিলা

তাহসান-মিথিলা
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তাহসানের ছোটবেলায় কাটানো ঈদগুলো এখন তাঁর কাছে অনেকটাই স্বপ্নের মতো মনে হয়। ঈদের সকালে গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি পরে বাবার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়া, তারপর মসজিদে নামাজ শেষে বাবাকে সালাম করে সবার সঙ্গে কোলাকুলি। বাসায় ফিরেই শুরু হতো সালামি উৎসব। মাকে সালাম করা দিয়ে সেই উৎসবের শুরু, তারপর আত্মীয়স্বজন আর সবশেষে বন্ধুদের বাসায় ভিড় করা। ‘ছোটবেলার ঈদের ঘোরাঘুরিগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল অনেকটা সালামিকেন্দ্রিক’ —তাহসানের কথাটা অন্তত এমনই। সেই অর্থে তাহসান একজন মনের মতনই সঙ্গী পেয়েছেন বলা চলে! স্ত্রী মিথিলার ছোটবেলার ঈদগুলোও ছিল অনেকটা তাহসানের মতোই। মিথিলারও ঈদের মূল আকর্ষণীয় বিষয় ছিল সালামি। পরিবারে চাচা-চাচিসহ একসঙ্গে থাকতেন। ঈদের সকাল হলেই শুরু হতো আনন্দ। নতুন জামা পরে দাদার বাসায় যেতেন। ফুফুদের সালাম করে তাঁদের কাছ থেকেই পেতেন প্রথম সালামি। এভাবে একের পর এক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া আর সালামি নেওয়া। প্রতিটি ঈদে অনেকগুলো জামা উপহার পেতেন। মাঝেমধ্যে বাসায় এসে একটা জামা ছেড়ে আরেকটা জামা পরার ব্যাপারটাও তাঁর কাছে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ধরা দিত। নিজের একটু বড় কাজিনদের সালাম করতে গেলে ওরা দৌড়ে পালাত, সালামি দিতে চাইত না, সেটা নিয়ে ছোটবেলায় খুব মন খারাপ হতো মিথিলার। আবার নিজের ছোট কোনো কাজিন যখন তাঁকে সালাম করতে আসত তখন তিনিও দৌড়ে পালাতেন। ভাবখানা এমন ‘আমি সালামি নিতে জানি, দিতে জানি না’। বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলবেলায় ঘোরাঘুরি শেষে টিভিতে ঈদ অনুষ্ঠান দেখতে দেখতেই কেটে যেত তাঁর পরের সময়টুকু। বিয়ের পর তাহসান-মিথিলা দম্পতির ঈদগুলোতে এসেছে কিছুটা নতুনত্ব। ঈদের সকালে তাহসান নামাজ পড়ে ফেরেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুজনের সময়টা তোলা থাকে বাসায় আগত অতিথিদের জন্য। বাসায় আসা মেহমানদের আপ্যায়ন করেন। সালামি নেওয়ার বয়সটা পেরিয়ে গেছে, তাই হয়তো এখন সবাইকে সালামি দিতে কার্পণ্য করেন না দুজনের কেউই। বিকেলের দিকের সময়টা দুজন চেষ্টা করেন নিজেদের জন্য রাখতে। দুজন মিলে ঘুরতে বের হন। সবশেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। রাতের খাবারটা বন্ধুদের সঙ্গে নয়তো দুজন মিলে বাইরেই সেরে আসেন, ঠিক এভাবেই কেটেছে বিয়ের পরের তাহসান-মিথিলা দম্পতির ঈদের সময়গুলো। এবারের ঈদের পুরো আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে তাঁদের সংসারের নতুন অতিথি আইরা তেরিম খান। স্বাভাবিক-ভাবেই আইরাকে ঘিরে এবার বাসায় আগত মেহমানদের ভিড় থাকবে একটু বেশি। সেটিকে নতুন আরেকটি আনন্দ হিসেবেই দেখছেন তাহসান-মিথিলা দম্পতি। মেয়েকে নিয়ে পরিবারের অন্য সবার মধ্যে উত্তেজনাটা দুজনে ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছেন। এখন শুধু ঈদের দিনটির জন্যই অপেক্ষা।

শিমুল-নাদিয়া

শিমুল-নাদিয়া


শিমুলের কাছে ছোটবেলায় কাটানো ঈদগুলো ছিল একেবারেই অন্য রকম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই জীবনে প্রথমবারের মতো রোজা রেখেছেন। অনেক ছোট বলে বাবা-মা সেহিরতে ঘুম থেকে তুলতে চাইতেন না, সেটা ছিল তাঁর কাছে একটা কষ্টের ব্যাপার। তার পরও নানা বায়নায় সেহিরতে উঠে রোজা রাখতেন। পরিবারে চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন বলে সবকিছুতে সব সময় পেতেন একটু বাড়তি অগ্রাধিকার। ছোট বয়সে ফ্যাশন বুঝতেন না, কিন্তু পোশাকের ব্যাপারে ছিলেন খুঁতখুঁতে। নিজের পছন্দের পোশাকটি ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরতে চাইতেন না। বড় ভাইদের ঈদের জামাগুলোর মতো করে জামা পরতে চাইতেন বলে তাঁকে নিয়ে সবাইকেই একটা ঝামেলা পোহাতে হতো। ছোটবেলায় সেই সময়ের প্রচলিত ফ্যাশন ছিল ডিসকো শার্ট আর বেলবটম জিনস। ঈদের দিনে বড় ভাইদের জন্য কেনা সে পোশাকগুলো দেখে নিজের জন্যও সেটা কেনার বায়না ধরতেন। ছোটদের জন্য তেমন পোশাক হয় না, এ কথা তাঁকে বোঝায় কার সাধ্যি? সাইজের কারণে কেনা না গেলেও শেষ পর্যন্ত কাপড় কিনে তাঁকে বানিয়ে দেওয়া হতো সে রকমের পোশাক। ঈদের আগের দিন একটা কাজ সব সময় করা হতো তাঁর। বাসায় কেনা জুতার শক্ত বাক্সগুলোর ওপরটায় কাঁচি দিয়ে কেটে ‘ঈদ মোবারক’ লিখে দিতেন, আর সেটা রঙিন কাগজে মুড়ে তার পেছনে একটা লাইট জ্বালিয়ে সেটা ঝুলিয়ে দিতেন বাসার সামনে। ঈদের সকালে বাবা আর বড় ভাইদের সঙ্গে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। এরপর পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া আর বাসায় ফিরে টিভিতে ঈদ অনুষ্ঠান দেখা—এভাবেই কেটে যেত ঈদ। সেই তুলনায় স্ত্রী নাদিয়ার ছোটবেলার ঈদটা ছিল একটু ব্যতিক্রমী। রোজার শুরু থেকেই তাঁর যাবতীয় চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেত ঈদের পোশাককে ঘিরে। কী ধরনের পোশাক পরবেন, সঙ্গে থাকবে কোন অনুষঙ্গ, সেটা নিয়ে অস্থির থাকতেন সব সময়। দোকানে ঘুরে ঘুরে কাপড় কেনা, জামা বানাতে দেওয়া—এসব করতে করতেই চলে আসত ঈদ। নতুন জামাটি যেন ঈদের আগেই কেউ না দেখে ফেলে, সেটা নিয়ে নাদিয়া থাকতেন বাড়তি দুশ্চিন্তায়। নতুন কেনা জুতাগুলোও তুলে রাখতেন বিছানার ওপরে। আর ঈদের সকালে নতুন জামা পরে সবাইকে সালাম করা, সালামি নেওয়ার ব্যাপারগুলো ছিল সে সময় তাঁর কাছে মহা আনন্দের ব্যাপার। বিকেলের দিকে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া আর টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখা—এই ছিল ঈদের শেষ সময়ের কাজ।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের আনন্দটাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে বলে মনে করেন শিমুল-নাদিয়া দম্পতি। এখন দুজনের দায়িত্বও বেড়েছে অনেক। নিজেদের প্রিয়জনদের জন্য কেনাকাটা করা দিয়ে সে দায়িত্ব পালনের শুরু। শিমুলের জন্য কেনাকাটা মূলত স্ত্রী নাদিয়াই করেন। পাশাপাশি প্রিয়জনদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারগুলো তো থাকেই। ঈদের সকালে অতিথিদের দুজনে মিলে আপ্যায়ন করেন। পরস্পরের বাবা-মাকে সালাম করার ব্যাপারটা দুজন এক ফাঁকে সেরে ফেলেন। কাজের শেষে শিমুলের প্রথম পছন্দের ব্যাপারটি হলো, বাড়িতে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে লম্বা একটা ঘুম দেওয়া। কিন্তু সেযাত্রায় সব সময়ই নাদিয়া বাধা হয়ে দাঁড়ান। এরপর দুজন মিলে ঘুরতে বের হওয়া। ঈদের বিকেলে দুজন নিয়ম করে নাদিয়ার বড় খালার বাসায় যান। বড় খালার মৃত্যুর পর সে আনন্দ কিছুটা ফিকে হয়েছে বটে, কিন্তু কাজিনদের সঙ্গে আড্ডা মারার আনন্দটা নাদিয়া মিস করতে চান না কোনোভাবেই। তারপর নিজেদের মতো করে ঘোরাঘুরি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ শেষ করে দুজনে ফিরে আসেন নিজেদের ছোট্ট নীড়ে। ঠিক এভাবেই কেটে যাবে দুজনের একসঙ্গে এবারের ঈদ।