>তাঁরা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই চরিত্রে অভিনয় করেই তাঁরা তারকা। নাটকের কলাকুশলীসহ ভক্তরাও তাঁদের মা বলেই ডাকেন। কিন্তু এখন অভিনয়ে কম দেখা যায় তাঁদের। কারণ কী? তবে কি কমছে মায়ের চরিত্র? আগামী রোববার মা দিবস সামনে রেখে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত লিখেছেন হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক

হিন্দি ছবি কাভি খুশি কাভি গাম কিংবা মহাব্বাতে-এর কথা মনে আছে? কিংবা সম্প্রতি ওপার বাংলা থেকে এ দেশেও আলোচনায় আসা বেলাশেষে বা পোস্তর গল্প। সীমানা পেরিয়ে যেতে চাইছেন না, তাহলে আজ থেকে ১০-২০ বছর আগে এ দেশের টেলিভিশন নাটকের দিকে খেয়াল করুন। কিংবা চলচ্চিত্রে। পারিবারিক গল্প নিয়েই নির্মিত হতো বেশির ভাগ নাটক। আলাদা করে নাম বলতে হবে না, বেশির ভাগ নাটকেই মা একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। এমনও হয়েছে, নাটক বা চলচ্চিত্রটি শেষ অবধি টেনে নিয়ে যেতেন মা ও বাবা। তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত নাটকের গল্প।
কিন্তু এখন দিন বদলেছে। নাটকে মা-বাবা চরিত্রের দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করেছে। এমনও হয়েছে, মা-বাবার চরিত্র ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে বেশির ভাগ নাটক। এমন অভিযোগ বেশির ভাগ নাটকের শিল্পী-কলাকুশলীদের। এই সময় মায়ের চরিত্রে বেশি অভিনয় করেন, দিলারা জামান, ডলি জহুর, শর্মিলী আহমেদ, জাহানারা আহমেদসহ নতুন–পুরোনো বেশ কয়েকজন অভিনেত্রী। তাঁদের শুটিং স্পটেও মা বলেই ডাকা হয়। এসব অভিনেত্রীদের অভিযোগ, এখন মা ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে নাটক। অভিনেত্রী দিলারা জামানের ভাষায়, ‘মা-বাবার চরিত্র ছাড়া নাটক দেখলে মনে হয় ছেলেমেয়ে যেন আকাশ থেকে পড়েছে।’ তিনি জানান, এই সময়ের বেশির ভাগ তারকাই তাঁকে মা বলে ডাকেন। শুটিং স্পটে এমন ডাক এবং অভিনয় দুটোই তিনি উপভোগ করেন। তাঁর কাছে সবাই সন্তানের মতো। কিন্তু নাটকে এখন মা অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় প্রিয় সন্তানদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগও কমে গেছে। তিনি বললেন, ‘আগে মাসজুড়ে শুটিং করতে হতো। এখন হাতে গোনো ১০-১২ দিন। ঈদের সময় তা-ও হয় না। তবে কিছু ধারাবাহিক নাটকে নিয়মিত অভিনয় করছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘দুইটা ছেলে-মেয়ে আর মোবাইল, এই হলেই এখনকার নাটক হয়ে যায়। আমাদের আর দরকার কী?’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, এখনকার সময়ে মা-বাবাহীন নাটকে যেসব ঘটনা দেখানো হয়, সেটা কতটা যুক্তিসংগত বা সামাজিক? তিনি মনে করেন, টেলিভিশন শুধু বিনোদনমাধ্যম নয়, শেখারও। সেই শিক্ষাটা আদৌ হয় কি?
একই মত দেন আরেক প্রবীণ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জাহানারা আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি মায়ের চরিত্রের চেয়ে দাদি চরিত্র বেশি করতাম। কিন্তু মায়ের চরিত্রই যেখানে তৈরি হচ্ছে না, সেখানে দাদির তো প্রয়োজনই নেই। মা-হীন নাটকের পেছনে তিনি একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘সংসারে একজন মুরব্বি যেমন দরকার, তেমনি নাটকেও দরকার। সেটা নাটকের জন্য শুধু সৌন্দর্যই নয়, গুরুত্বপূর্ণও। তিনি অনেকটা অনুযোগের সুরে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে আর অভিনয়ের জন্য কেউ ডাকে না। অথচ একটা সময় মাসের ২০-২৫ দিন শুটিং করতাম।’
তিনি জানান, বছরখানেক আগে আবুল হায়াতের পরিচালনায় বাবা তোমার হাতটা একটু ধরি নামে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তারপর মনে রাখার মতো কোনো নাটকেই কাজ করেননি তিনি।
মায়ের চরিত্র কমে যাওয়ার পেছনে চিত্রনাট্যকে দায়ী করেন অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে নাট্যকার মাসুম রেজাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মা ছাড়া একটা চিত্রনাট্য কীভাবে লেখেন আপনি? তিনি বলেছিলেন, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও পরিচালকেরা এভাবেই নাকি চিত্রনাট্য চান।’
ব্যাপারটি নিয়ে কথা হয় নাট্যকার মাসুম রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি। এখন বাজেট কমানোর জন্য নাটকে মা ও বাবা দুটি চরিত্র কেটে ফেলা হয়। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
ব্যাপারটি নিয়ে কথা হয় এটিএন বাংলার উপদেষ্টা (অনুষ্ঠান) নওয়াজীশ আলী খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মায়ের চরিত্র একেবারেই কমে যাচ্ছে। মনে হয় মায়ের দরকার নেই পরিবারে। এখন টেলিভিশনে যাঁরা নাটক নির্মাণ করেন, তাঁদের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও বলব, এর একটি হলো চিন্তার সীমাবদ্ধতা। আরেকটা হলো টাকাপয়সার সীমাবদ্ধতা। মা-বাবার চরিত্র এলেই তো বাড়তি সম্মানী দিতে হবে। এ কারণেই এটা বাদ দেওয়া হয়।’
নওয়াজীশ আলী খান বলেন, আধুনিক নাটকে পারিবারিক যে বন্ধন, সেটা দেখানো হয় না। ছেলে-মেয়ে আর বাইরের দু-একটা চরিত্র দিয়ে নাটকটি শেষ করা হয়।
টেলিভিশনের পক্ষ থেকেই চরিত্র কমিয়ে নাটক নির্মাণের কথা বলা হয়—এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘অন্য চ্যানেলের কথা বলতে পারব না। তবে আমাদের এখান থেকে এ ধরনের কোনো চাপ নেই।’
তবে ঘটনা যা-ই হোক, মা ছাড়া যেমন পরিবার অসম্পূর্ণ, তেমনি মায়ের চরিত্র ছাড়া নাটক অসম্পূর্ণ। এমনটাই মনে করেন নাটকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু সেটা মনে করলেও বাজেট, স্বল্প সময়ে নাটকের কাজ শেষ করা এবং চ্যানেলের চাপ, এ কারণে আপাতত মা-বিহীন নাটক বেশি নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু সেটা কাম্য নয় কারোরই।