
চলচ্চিত্র একটি শিল্প-ভাষা। এ ভাষার মূল উপাদান দৃশ্য আর ধ্বনি। দৃশ্য বা ইমেজকে ‘রূপ’ হিসেবে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চলচ্চিত্রে রূপের প্রবাহ দেখতে চেয়েছিলেন। সংগীত যেমন ধ্বনির প্রবাহ, সিনেমায় তেমনি ইমেজের পর ইমেজ সাজিয়ে গল্প বলা যায়। মেঘমল্লার এমনই একটি চলচ্চিত্র, এমনই একটি গল্প, যেটি দেখার আর অনুভবের। সিনেমায় গল্প বলার যে উচ্চকিত ধারা আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে, সে প্রচলিত ধারার বিপরীতে গিয়ে জাহিদুর রহিম অঞ্জন এ ছবিতে এমন গভীরভাবে গল্প বলেন, যা কয়েকটি অনুচ্ছেদে, কয়েক শ শব্দে তুলে ধরা অসম্ভব। দৃশ্য আর ধ্বনি মিলিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, এমনকি বোধের বাইরে মেঘমল্লার যে অনুভব উপহার দেয়, সে অভিজ্ঞতার জন্য বড় পর্দার যথাযথ পরিবেশে ছবিটি দেখা অত্যাবশ্যক।
বিশ্বায়নের এ যুগে ঘরে-বাইরে চিত্তাকর্ষক দৃশ্যের আর শ্রাব্য-অশ্রাব্য ধ্বনির অতিসমারোহ। আমরা সবাই স্বল্পস্থায়ী, বিনোদনের ক্রেতা-গ্রাহক। এ সময়ে মেঘমল্লার সুনির্বাচিত ইমেজ ও শব্দ দিয়ে আমাদের সাধারণ দৃশ্য-শ্রাব্য জগতের বাইরে নিয়ে যায়, এমন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে আমাদের, যা এ দেশের একজন হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য জরুরি।
১৯৭১। বর্ষাকাল। পাকিস্তানি বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশ। এ ভয়ের রাজত্বে দুঃসহ জীবন কেটেছে অনেকের। এমনই একটি পরিবার-কলেজ শিক্ষক নুরুল হুদা, তাঁর স্ত্রী আসমা ও চার বছরের মেয়ে সুধা। সন্ত্রস্ত হুদার চেষ্টা স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে নিরাপদে থাকার, বেঁচে থাকার। আসমার ভাই মিন্টু যে অন্য তরুণদের সঙ্গে যুদ্ধে গেছে, হুদা তাকে কিংবা তাদের বিস্মৃত হয়ে থাকতে চায়। কলেজে ক্লাস নেই, ছাত্র নেই, তবু প্রতিদিন সকালে শেভ করে, তৈরি হয়ে নুরুল হুদা অফিসে যান, মিটিং করেন সহকর্মীদের সঙ্গে। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারে না তাঁর এই ‘নিয়মিত’ জীবন থেকে। কলেজের নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলে পরদিন হুদাকে তলব করেন পাকিস্তানি মেজর। মুক্তিযোদ্ধা মিন্টুর ছেড়ে যাওয়া রেইনকোট পরে প্রবল বর্ষণের মধ্যে হুদা কলেজে রওনা হন। অধ্যক্ষ ও সহকর্মীদের সামনে কলেজ থেকে হুদা ও আরেক সহকর্মীকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়। কিন্তু, কাহিনির এ বর্ণনা যত দীর্ঘকারে দিই না কেন, তাতে মেঘমল্লার-এর মূল রস কখনো ধরা দেবে না। দেবে না এ জন্য যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এ কাহিনিকে কাঠামো হিসেবে নিয়ে এখানে জাহিদুর রহিম অঞ্জন গড়ে তুলেছেন এক চলচ্চিত্রীয় পরিবেশনা। এ পরিবেশনার কাহিনি যেন উপলক্ষমাত্র। ক্যামেরা, সম্পাদনা, শব্দ, সংগীত—সব আয়োজন এখানে দর্শকদের একাত্তরের সেই সময়ে নিয়ে যাওয়ার। মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে অনুভব করার। পরিমিত সংলাপ, লংটেক (দীর্ঘস্থায়ী শট), স্থির শট, নীরবতা আর সংগীতের কারুকাজে আমরা সবাই সেই একাত্তরের বর্ষার বাংলাদেশে ভ্রমণ করি। কিন্তু, এ আয়োজনে মেঘমল্লার সহজ বা জনপ্রিয় আবেগের ডালা সাজায় না। বরং সিনেমায় গল্প নির্মাণের কঠিন রাস্তায় হেঁটেছেন অঞ্জন। ইউরোপীয় আর্ট সিনেমার ব্রেসোঁ কিংবা পরবর্তী সময়ে ভারেত মনি কাউল, পূর্ব এশীয় আর্ট সিনেমায় হো শা শিয়েন (তাইওয়ান) বা হং স্যাং-সু (কোরিয়া) যে মিনিমালিস্ট ধারার ছবি নির্মাণ করেছেন, জাহিদুর রহিম অঞ্জন সে ধারার অনুসারী। চলচ্চিত্র ভাষার উপাদান, ইমেজ আর ধ্বনি ব্যবহারে তিনি অতিসংযম ও মিতব্যয়িতার মাধ্যমে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতার ডালি তুলে ধরেন। আমরা বা আমাদের চোখ-কান সচকিত হয়ে ওঠে এ অভিজ্ঞতার সবটুকু গ্রহণ করার জন্য।
মনি কাউলের ছাত্র অঞ্জন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্র পরিচালনার পাঠ শেষ করেছেন। শর্ট ফিল্ম আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন অনেক দিন ধরে। একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ও টেলিভিশনের জন্য প্রযোজনা নির্মাণ করেছেন। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের জন্য আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। মেঘমল্লার সে অপেক্ষার শেষ ঘটিয়েছে। আমরা বিস্ময় ও আনন্দের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলাম এক শক্তিশালী চলচ্চিত্রনির্মাতার আবির্ভাব। বাংলাদেশ সরকারের অনুদান সহায়তার, বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্টের প্রযোজনার মেঘমল্লার নির্মাণে অঞ্জন চলচ্চিত্র-শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের নিয়ে দল গড়েছেন। নির্বাহী প্রযোজক নুরুল রাশেদ চৌধুরী, চিত্রগ্রাহক সুধীর পালসানে, শব্দ পরিকল্পনায় রতন পাল, সম্পাদনায় সামীর আহমেদ ও জুনায়েদ হালিম, সংগীতে অভিজিৎ ঘোষ—প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর কাজে দক্ষতা ও প্রতিভার সম্মিলন ঘটিয়েছেন। শহিদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা, জারা ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁদের সেরা অভিনয় উপহার দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কী ছিল, কতটা ছিল তা বোঝার জন্য মেঘমল্লার দেখা জরুরি। চলচ্চিত্রের ভাষায় খুব সীমিত পরিসরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভয়াবহতাকে সিনেমার পর্দায় অনুভবের জন্য এ ছবি দেখতে হবে। একটি রেইনকোট এখানে যেন ‘আসাদের শার্ট’। এ রেইনকোট আমার, আপনার, আমাদের সবার।
লেখক: চলচ্চিত্র গবেষক, অধ্যাপক ও ডিন, সামাজিক বিভাগ অনুষদ, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়