হারিয়ে গেছে সিডি, কপিরাইটে সোচ্চার
>দেশের সংগীতাঙ্গনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে গত এক দশকে। ফিতার ক্যাসেটের পরে সিডি–ভিসিডি বিদায় নিয়েছে। চলতি দশকে কালেভদ্রে দুয়েকটি সিডির দেখা মিললেও ক্যাসেট পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। কমেছে খোলা ময়দানে ব্যান্ডের কনসার্ট ও অ্যালবামের সংখ্যা। ২০১০ থেকে ২০১৯—এই ১০ বছরে গান কানের পাশাপাশি চোখেও পৌঁছেছে। শোনার পাশাপাশি পুরোপুরি দেখারও হয়ে গেছে। বাজার হয়েছে ‘ভিউ’কেন্দ্রিক। এসব নিয়ে লিখেছেন মাসুম আলী
নবাবপুর, পাটুয়াটুলী থেকে মগবাজারে
১০ বছর আগে যাঁরা ঢাকার পাটুয়াটুলী ও নবাবপুর এলাকায় গেছেন, তাঁরা আজ সেখানে গেলে চিনতে একটু কষ্টই হবে। একদম বদলে গেছে চারপাশ! এখন আর এখানে নেই গানের বাজার। অথচ বছর দশেক আগেও সারা বছরই এখানে শোনা যেত গানের আওয়াজ। এখানে পথে চলতে গেলে ভেসে আসত নতুন কাগজের গন্ধ। এলাকার ভবনগুলোর দেয়ালে থাকত নতুন অ্যালবামের পোস্টার। ঈদ এলে এখানে রীতিমতো উৎসব লেগে যেত। দেশের অডিও বাজার নিয়ন্ত্রণ হতো এই এলাকা থেকে।
এখন এসব অঞ্চলের দেয়ালে দেয়ালে নেই নতুন অ্যালবামের পোস্টারের ছড়াছড়ি, নেই শত শত ক্যাসেট কিংবা সিডি। নেই অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানেরও কোনো কার্যালয়। কয়েক বছর আগে যেখানে ছিল শুধু ক্যাসেট–সিডির দোকান, এখন সেখানে মোবাইল, মেমোরি কার্ড, ঘড়ি—এমনকি বিরিয়ানির দোকান। মূলত গানের বাজারের পাটুয়াটুলী, নবাবপুরের রাজত্ব এখন মগবাজারে ।কার্যক্রম ছোট পরিসরে চলছে।
ভাইরালে কাতর গানের বাজার
‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’, ‘অপরাধী’ কিংবা ‘আমি তো ভালা না’, ‘টিকাটুলির মোড়ে একটা সিনেমা হল রয়েছে’, ‘ও টুনির মা’—এগুলো গেল ১০ বছরের আলোচিত গানের অন্যতম। এর মূল কারণ, এই কবছরে গানের বাজার পুরোপুরি ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এই সময়ে গানের মান বিচার হয়েছে সংখ্যায়। ‘ভিউ’ শব্দটি এখন যেন পরিপূরক হয়ে গেছে সংগীতাঙ্গনে।
জনপ্রিয় শিল্পীদের অ্যালবাম নেই
১০ বছর আগেও গানের বাজারে সমকালীন জনপ্রিয় শিল্পীদের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। সৈয়দ আব্দুল হাদী থেকে শুরু করে হাবিব ওয়াহিদ, সাবিনা ইয়াসমীন থেকে ন্যান্সি প্রমুখ শিল্পী বছর শুরু করতেন নতুন গান দিয়ে, যা গানের বাজারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখত। গত ১০ বছরে জনপ্রিয় শিল্পীদের বেশির ভাগরই কোনো একক অ্যালবাম করেননি।
ব্যান্ডের অ্যালবাম নেই, কনসার্ট কমে গেছে
এ কবছরে জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকাদের উল্লেখ করার মতো কোনো মিশ্র অ্যালবাম বাজারে আসেনি। ব্যান্ড অ্যালবামের সংখ্যাটা প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়া দলগুলোর মিশ্র অ্যালবামও তেমন প্রকাশ পায়নি। একই সঙ্গে কমে গেছে উন্মুক্ত কনসার্টের সংখ্যা। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বা জাতীয় কোনো দিবস ছাড়া বিগত ১০ বছরে তেমন কনসার্ট হতে দেখা যায়নি। অল্প কিছু আয়োজনের মধ্যে ‘জয়বাংলা কনসার্ট’, ‘শেকড়ের সন্ধানে, ‘বামবা লাইভ চ্যাপ্টার ওয়ান’, ‘নো ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন’ ছাড়া আর অন্য কোনো আয়োজন তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।
উচ্চাঙ্গসংগীত, লোকগানে সারা রাত
১০ বছর আগেও সারা রাত জেগে খোলা ময়দানে উচ্চাঙ্গসংগীতে মজে যাওয়ার দৃশ্য ছিল ধারণার অতীত, কিন্তু এমন দৃশ্য বিগত ১০ বছরে বারবার দেখা গেছে। হাজার হাজার শ্রোতা শামিল হয়েছেন এমন আয়োজনে।
এদিকে–সেদিকে, পাড়া–মহল্লা বা বড় মাঠে কনসার্ট কমে গেলেও, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে সংগীত আসরের আয়োজন ছিল চলতি দশকের বড় প্রাপ্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি নিয়েছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। ২০১২ সাল থেকে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের রথী–মহারথীদের নিয়ে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব আয়োজন করে আসছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। আয়োজনটি বেশ সাড়া ফেলে দর্শকদের মধ্যে।
২০১৫ সালে লোকসংগীত নিয়ে সান ইভেন্টস ও মাছরাঙা টেলিভিশন প্রথমবারের মতো আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভ্যাল। ব্লুজ কমিউনিকেশনসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে জ্যাজ অ্যান্ড ব্লুজ উৎসব, বিগ রক ডে ও সুফি সংগীতের উৎসব।
গান শোনার অভ্যাস
গানের বাজার যেমন বদলে গেছে, তেমনি পাল্টে গেছে গান শোনার অভ্যাস। ১০ গানের সিডি অ্যালবাম কমতে কমতে ১ গানে এসে ঠেকেছে। রাস্তায় যানজটে আটকে গেলে চালক আর ক্যাসেট বা সিডির বক্স খোঁজেন না। মোবাইল ফোনের সঙ্গে শব্দযন্ত্রের সংযোগ করে একের পর এক দেশ-বিদেশের গান শোনেন। গান শোনেন আইটিউনসে, ইউটিউবে কিংবা অন্য কোনো ওয়েবসাইটে। কোনো গান ভালো না লাগলে টুক করে অন্য গানে চলে যান। কারণ, বাজারটা এখন তাঁর হাতে। আগের দশকে শুরু হওয়া এফএম রেডিও এ দশকেও শ্রোতার আগ্রহের তালিকায় ছিল, তবে আগ্রহটা একটু একটু করে এখন নিম্নমুখী।
মোবাইল সংযোগদাতা এবং শিল্পী নিজেই প্রযোজক
অগ্রসর শিল্পীদের অনেকে এখন নিজেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করছেন। অনেকেই নিজের ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন। নিজ উদ্যোগে গান করে তা পরিবেশন করছেন। কেউ কেউ সফলও হয়েছেন। এ তালিকায় যেমন প্রতিষ্ঠিত তারকা শিল্পী আছেন, তেমনি যশপ্রার্থী নবীনেরাও আছেন প্রযোজক, পরিবেশকের দায়িত্বে।
গ্রাহকদের সুবিধা ও ব্যবসার কথা চিন্তা করে মোবাইল ফোন সংেযাগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গানের বাজারে বিনিয়োগ করেছে বড় মূলধন। এসব ডিজিটাল মাধ্যমে শুধু গান শোনাই যাচ্ছে না, সরাসরি এখান থেকে গান প্রকাশিতও হচ্ছে।
প্রযোজকেরা চ্যানেল খুলছেন
ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ইউটিউব হয়ে উঠেছে গান দেখা ও শোনার সবচেয়ে বড় জায়গা। এ জন্য গান প্রকাশকেরা ইট-কাঠের অফিস, শোরুমের বদলে ইউটিউবে খুলেছেন নিজস্ব চ্যানেল। চ্যানেলের গ্রাহক বাড়াতে চালাচ্ছেন নানা কৌশল। ইউটিউবে অবাধ ব্যবসার জন্য প্রতিযোগিতা করছেন ভেরিফায়েড চ্যানেলের জন্য, সিলভার ও গোল্ডেন বাটনের জন্য। এতে ব্যবসায় আসছে স্বচ্ছতাও।
কপিরাইট–সচেতন শিল্পীসমাজ
এককালীন কিছু টাকা দিয়ে একটি গান কিংবা ১২ গানের একটি অ্যালবামের চিরস্থায়ী মালিক হওয়ার দিন শেষ। গত ১০ বছরে সংগীত বাজারে আলোচনার বড় বিষয় ছিল কপিরাইট অধিকার। এতে শিল্পীরা যেমন সচেতন হয়েছেন, তেমনি সরকারি উদ্যোগও হয়েছে সক্রিয়। গঠিত হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (আইপিআর) টাস্কফোর্স। কপিরাইট অফিস নানা সময় কপিরাইট–সচেতনতায় শিল্পীদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসে সরাসরি অর্থদণ্ড করেছে কপিরাইট রেজিস্ট্রার। মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে আলাপ, সচেতনতা বা বাস্তবায়নের বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়।
পুরোনো গানের নতুন শিল্পী, নতুন পরিবেশনা
আগের দশকে রিমিক্স গানের প্রভাব ছিল। চলতি দশকেও পুরোনো গানের দারুণ প্রভাব ছিল। নানা সময়ে প্রতিষ্ঠিত কিংবা নবীন শিল্পীরা জনপ্রিয় গান নিজেদের মতো গেয়ে সাড়া ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যানেলের গানের আয়োজনগুলো ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল গান বাংলা চ্যানেলে প্রচারিত ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ অনুষ্ঠানটি। ভিন্নধারার অনুষ্ঠানটি শুরু থেকেই বাংলা গানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের নানা দেশের মিউজিশিয়ানদের এ অনুষ্ঠান এক মঞ্চে এনেছে। ইউটিউব প্রজন্মকেও শিকড়ের সুর, পুরোনো গানের সুর পৌঁছে দেওয়ায় ভূমিকা রাখে অনুষ্ঠানটি। শুধু নানা দেশ নয়, এক করেছে নানা প্রজন্মের শিল্পীকেও। এ ছাড়া সিলন মিউজিক লাউঞ্জ, লিজেন্ড অব রকসসহ বেশ কিছু অনুষ্ঠান শ্রোতার (দর্শক) মধ্যে সাড়া ফেলেছে।
আরও পড়ুন
-
ঢাকাসহ ৫ জেলা: মাধ্যমিক কাল বন্ধ হলেও প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলাই থাকছে
-
ঢাকাসহ ৫ জেলার মাধ্যমিক স্কুল–কলেজ কাল বন্ধ ঘোষণা
-
ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের নিয়ে দপ্তরে উপাচার্য, শিক্ষকদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি
-
সাবেক স্ত্রীর করা ৩ মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান
-
কাজ না পেয়ে প্রকৌশলীর শার্টের কলার ধরলেন ঠিকাদার