
১৯৭৪ সালে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনের দুটি নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয়। শহর ও গ্রামের পটভূমিতে ‘সুবচন নির্বাসনে’ ও ‘এখন দুঃসময়’ নাটক দুটি ওই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করেন নাট্যজন সৈয়দ জামিল আহমেদ।
আজ বিকেলে নাট্যদল থিয়েটার আয়োজিত একক বক্তৃতানুষ্ঠানে সৈয়দ জামিল আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক দুটি নিয়ে এ মন্তব্য করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘সন ১৯৭৪, স্থান: বাংলাদেশ, আবদুল্লাহ আল-মামুন কহেন দুঃসময়ের সুবচন’।
থিয়েটার মঞ্চায়িত বেশির ভাগ নাটকের নাট্যকার ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল নাট্যদলটির এ আয়োজনের উপলক্ষ ছিল তাঁর ৭৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন।
‘সুবচন নির্বাসনে’ নাটকে তিনটি সুবচন মিথ্যা প্রমাণিত হয়। নাটকটিতে এক স্কুলমাস্টারের বড় ছেলে খোকন পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করার পর একটি অফিসে চাকরিপ্রার্থী হয়। অন্যদিকে তারই সহপাঠী তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করে ওই একই অফিসে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে যায়। এভাবেই মিথ্যে প্রমাণিত হয় ‘সততাই মহৎ গুণ’ সুবচনটি। স্কুলমাস্টারের ছোট ছেলে তপন মেধাবী ছাত্র, কিন্তু বড় ভাইয়ের অবস্থা দেখে পড়াশোনা ছেড়ে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’ সুবচনটিকে আর সত্য বলতে পারে না সে। একমাত্র মেয়ে রানু চরিত্রহীন স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ‘সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে’ সুবচনটি মিথ্যে প্রমাণিত হয় এখানে। নাটকের শেষদিকে স্কুলমাস্টারকে তিন সন্তান কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলে, তাদের করুণ পরিণতির জন্য পিতাই দায়ী। বৃদ্ধ পিতা দায় স্বীকার করেন। নাট্যকার বিচারের ভার অর্পণ করেন দর্শকের হাতে।
সৈয়দ জামিল বলেন, ১৯২০-এর দশকে ঔপনিবেশিক ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান হয়। তিনি বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করে প্রমাণ করেন, তিনটি সুবচনের প্রথম দুটিই সে সময় প্রচারিত হয়। ইংরেজরা মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের চিন্তায় ইংরেজ করে তুলেছিল। সে মধ্যবিত্তদের মধ্যেও তিন শ্রেণি ছিল। ব্যবসায়ী, কলকারখানার মালিকেরা ছিলেন উচ্চস্তরে। মধ্যস্তরে ছিলেন পেশাজীবীরা। নিম্নস্তরে ছিলেন নিম্ন বেতনভুক সরকারি কর্মচারীরা। প্রথম দুটি সুবচন এই মধ্যস্তর ও নিম্নস্তরের মধ্যবিত্তদের মধ্যেই বেশি সংক্রামিত হয়েছিল। ‘সততাই মহৎ গুণ’ সুবচনের নেপথ্যে ছিল ইংরেজ প্রবচন ‘অনেস্টি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি’। ধারণা গড়ে উঠেছিল, ইংরেজরা তুলনামূলক সৎ। এই সুবচনে ইংরেজরা বেশ গ্রহণযোগ্যতাও পায়। ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’ সুবচনটির নেপথ্যে ছিল নিম্নস্তরের মধ্যবিত্তদের ইংরেজ বড় বাবুদের সমান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ‘সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে’ সুবচনটি প্রচারিত হয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাঙালি নারীকে শাসনের উদ্দেশ্যে। এই সুবচনই হয়ে ওঠে নারীদের নৈতিকতার মানদণ্ড, তাই তো এর দ্বিতীয় লাইন ‘গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’ বরাবরই অনুচ্চারিত থেকেছে। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন সময়ে এ সুবচনগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।
‘এখন দুঃসময়’ নাটকটি একটি বন্যাদুর্গত গ্রামের পটভূমিতে নির্মিত। নাটকটিতে সোনা জরিনাকে ভালোবাসে। কিন্তু সোনার কোনো চালচুলো নেই বলে জরিনার বাবা এ সম্পর্ক মেনে নেয় না। একসময় জরিনার আশ্রয় হয় জোতদার কালু ব্যাপারীর কাছে। বন্যাকবলিত গ্রামে কালুর অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ। নাটকের একপর্যায়ে সোনা কালু ব্যাপারীকে হত্যা করে।
সৈয়দ জামিল সমালোচনা করে বলেন, নাটকটি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করলেও আবদুল্লাহ আল-মামুন তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে এখানে ঠিকভাবে আনেননি। আবদুল্লাহ আল-মামুনও পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নাটকটি তাঁর আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তিনি কেবল দেখাতে চেয়েছিলেন, বন্যায় অভাবীদের কী রকম সমস্যা হয়। তাঁদের ‘রিলিফ’ দেওয়ার নাম করে কেবল প্রচার-প্রচারণাটুকুই হয় মূল উদ্দেশ্য।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সম্মেলন কক্ষে ছিল এ আয়োজন। এরপর সন্ধ্যা সাতটায় স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত ও নির্দেশিত নাটক ‘মেরাজ ফকিরের মা’।