
ভারতে নেটফ্লিক্সের প্রথম দিকের সবচেয়ে আলোচিত সিরিজগুলোর একটি ‘সেক্রেড গেমস’। সিরিজটির অন্যতম পরিচালক অনুরাগ কশ্যপ। কয়েক বছর ধরেই প্ল্যাটফর্মটির নানা কার্যক্রমের কট্টর সমালোচক তিনি। অনুরাগ নতুন করে আলোচনায় একটি সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি ইউটিউব চ্যানেল দ্য জগানাটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার কার্যক্রমকে রীতিমতো ধুয়ে দিয়েছেন এই নির্মাতা। যা নিয়ে ভারত তো বটেই, বিদেশেও চলছে তুমুল বিতর্ক।
অনুরাগের অভিযোগ, নেটফ্লিক্সের নেতৃত্ব এবং বিশেষ করে ভারতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ধরন একেবারেই ভারতীয় দর্শকদের চাহিদা, রুচি কিংবা গল্প বলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। তিনি সরাসরি নেটফ্লিক্সের সহপ্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টেড সারানডোসকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘ভারত সম্পর্কে যা বলা হয়, সেটাই তিনি অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন।’
সাক্ষাৎকারে অনুরাগ আরও বলেন, ‘আমি নেটফ্লিক্সের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিলাম, কারণ ওরা একই রকম বাজে জিনিস বানিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ওরা ভারতকে বোঝে না। টেড সারানডোস নিজেও ভারত সম্পর্কে জানেন না। তাঁকে ভারতের অফিস যা বুঝিয়েছে, তিনি সেভাবেই বুঝেছেন। আর ওদের বলা সবই আসলে ফালতু কথা।’
টিভির বাজে লোকজন চালাচ্ছে নেটফ্লিক্স
এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অনুরাগ অভিযোগ করেন, ভারতের টিভিতে কাজ করা ব্যর্থ ব্যক্তিরাই এখন নেটফ্লিক্সের দায়িত্বে। এমন অপেশাদার লোকজনের কারণে ওটিটি প্ল্যাটফর্মটি ভারতে ভালো করতে পারেনি বলেও মনে করেন তিনি। অনুরাগের ভাষ্যে, ‘নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের দখলে, যারা টেলিভিশনেও কিছু করতে পারেনি। যাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, কোনো সাহস নেই। তারা শুধু অ্যালগরিদম আর সাবস্ক্রিপশন নিয়েই চিন্তিত। নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার কনটেন্টের মান সেই একই ফর্মুলা মেনে চলছে, যা একসময় ভারতীয় টিভিকে নষ্ট করেছিল। এখন শুধু দর্শকদের সেটার জন্য পয়সা দিতে হচ্ছে। অথচ সেই জিনিস অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।’
‘সব ভালো শো কিনে আনা’
এই পরিচালক আরও বলেন, নেটফ্লিক্স মৌলিকতা আর সাহসের অভাবে ভুগছে, বিশেষ করে নতুন বা ব্যতিক্রমী গল্প প্রযোজনা করার ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, ‘ওরা নিজের পিঠ নিজে চাপড়ায় সেই শোগুলোর জন্য, যেগুলো প্রযোজনা করার সাহস পর্যন্ত তাদের ছিল না—এটা শুনেই আমার সবচেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয়।’
নেটফ্লিক্সের কনটেন্ট নীতির কঠোর সমালোচনা করে অনুরাগ আরও বলেন, ‘সব ভালো শো-ই ওদের কিনে আনা। “স্কুইড গেম”, “অ্যাডলসেন্স”, “ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট”-এর মতো কন্টেন্টগুলো তারা কিনে এনেছে। আর যে কন্টেন্টগুলো সত্যিই দর্শক দেখতে চায়, যেমন “কোহরা”রা বা “ট্রায়াল বাই ফায়ার”; সেই শোগুলোর প্রচার পর্যন্ত তারা করেনি।’
‘তারা জানেই না তারা কেন পিছিয়ে আছে’
নেটফ্লিক্স কেবল সাবস্ক্রিপশন বাড়াতেই ব্যস্ত বলেও মন্তব্য করেন অনুরাগ। তিনি বলেন, প্ল্যাটফর্মটি কেবল সাবস্ক্রিপশন নিয়েই ব্যস্ত। ভারতের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনসংখ্যা—এটাই নেটফ্লিক্স নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি মনে করে। তারা ভাবে, ভারতের এই বিশাল জনসংখ্যার বাজার মানেই সাফল্য। কিন্তু বাস্তবে তারা বুঝতে পারছে না যে প্রতিযোগীদের চেয়ে ভালো কিছু না দিলে কেউ সাবস্ক্রিপশনের পেছনে টাকা ঢালবে না।
‘তারা শুধু নিজেদের চাকরি বাঁচানোর জন্য কাজ করছে’
নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পর্কেও অনুরাগ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘এখন পুরো সিস্টেমটা চালায় প্রযুক্তি বিভাগের লোকেরা। আর তারা খারাপ টিভি থেকে লোক নিয়োগ করেছে। ভেতরে যারা কাজ করছে, তাদের কেউই আসলে কিছু বোঝে না। তারা শুধু নিজেদের চাকরি বাঁচানোর জন্য কাজ করে। এ রকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, যা তারা আগে স্বপ্নেও ভাবেনি। তাই তারা কিছুতেই সে জীবন ছাড়তে চায় না। সাহসী সিদ্ধান্ত, মানসম্মত কনটেন্ট—এসব ওদের চর্চার বিষয়ই নয়। শুধু নিজেদের পিঠ বাঁচানো আর বাহবা নেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে হতাশা
অনুরাগ দীর্ঘদিন নিজের সিনেমা নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। ভারতীয় সার্টিফিকেশন বোর্ডের সঙ্গে বিস্তর লড়াই হয়েছে। তাঁর একটি সিনেমা মুক্তিই পায়নি। যখন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর মতো স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য এটা নতুন সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটাই। ‘যখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো এল, তখন মনে হয়েছিল এক নতুন বাতাস বইছে। নতুন শো আসছিল, নতুন গল্প বলার ধরন দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন দেখছি নেটফ্লিক্সের বদলে দর্শকেরা কোরিয়ান শো-ই বেশি দেখছে’, বলেন তিনি।
আগেও নেটফ্লিক্সের বিরুদ্ধে বলেছেন অনুরাগ
এটাই নেটফ্লিক্সের সঙ্গে অনুরাগ কশ্যপের প্রথম বিরোধ নয়। এর আগেও নেটফ্লিক্স নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন অনুরাগ। তাঁর পরিচালিত ‘সেক্রেড গেমস’-এর দ্বিতীয় মৌসুম অনুমোদন করেনি প্ল্যাটফর্মটি। তাঁর আরেকটি সিনেমাও ঘোষণা দিয়েও পরে পিছু হটে। তখনো সাক্ষাৎকারে প্ল্যাটফর্মটিকে কার্যত ধুয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে ইনস্টাগ্রামে ‘অ্যাডলসেন্স’ সিরিজের সফলতা নিয়ে টেড সারানডোস পোস্ট দেন। উচ্ছ্বাস নিয়ে টেড সেই পোস্টে লিখেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে এমন কিছু আসে, যেটা নতুন সীমা ছুঁয়ে ফেলে, সৃজনশীলতার সব গণ্ডি পেরিয়ে যায়।’ অনুরাগ টেডকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘আমি আশা করি, তিনি (টেড) সত্যিই সেটা বোঝেন। কারণ, নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া তো উল্টো পথে চলছে। এটা (অ্যাডলসেন্স) যদি নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়াকে প্রস্তাব দেওয়া হতো, তারা হয়তো বাতিলই করে দিত। কিংবা ৯০ মিনিটের একটা সিনেমা বানিয়ে ফেলত (তাও সম্ভব নয়, কারণ এই গল্পের তো কোনো সাদাকালো সমাপ্তি নেই।’
অনুরাগ একাই নন
কেবল অনুরাগ কশ্যপই নন, গত কয়েক বছরে নেটফ্লিক্সের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন প্রথম সারির বেশ কয়েকজন ভারতীয় নির্মাতা। যাঁদের মধ্যে অন্যতম দিবাকর ব্যানার্জি। দিবাকরের সিনেমা ‘তিজ’ নেটফ্লিক্স প্রযোজনা করে। কিন্তু সিনেমা নির্মিত হওয়ার পর রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে সেটা মুক্তি দেয়নি। যদিও প্রকাশ্যে তারা সেটা স্বীকার করে না। দিবাকর এখন সিনেমাটি নেটফ্লিক্সের কাছ থেকে কেনার জন্য দেশ-বিদেশের প্রযোজকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।
ভারতীয় গণমাধ্যম মানি কন্ট্রোলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিবাকর বলেন, ‘এখন সিনেমা নুডলসের মতো হয়ে গেছে। যেন কারখানায় তৈরি হয়। একটা চললে আরেকটিও সেভাবে বানাতে বলা হয়। প্ল্যাটফর্ম কেবল বড় তারকা আর একই ধরনের গল্পের পেছনে ছুটছে। তারা চায় নিশ্চিত মুনাফা। এর বাইরে কালেভদ্রে অন্য রকম কিছু মুক্তি দিলেও সেটার প্রচার করে না।’
দিবাকর মনে করেন, নেটফ্লিক্সসহ ভারতের অন্য প্ল্যাটফর্মগুলো ‘তাণ্ডব’ নিয়ে বিতর্কের পর অতি সতর্ক হয়ে গেছে। এর আগে আলী জাফর আব্বাসের সিরিজটি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়, যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। দিবাকর বলেন, ‘ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে তরুণেরা কাজ করতে আসে গ্ল্যামারের কারণে, বড় তারকাদের সঙ্গে দেখা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একের পর এক মামলা দিয়ে তাদের জেরবার করা হলে তারা যাবে কোথায়? ফলে কেউই আর ঝুঁকি নিতে চায় না।’
‘সাংসাই’, ‘লাভ সেক্স অউর ধোঁধা’, ‘সন্দীপ অউর পিংকি ফরার’ নির্মাতা দিবাকর মনে করেন, প্ল্যাটফর্মগুলোর এমন আচরণ যেমন নতুন নির্মাতাদের জন্য বাধা তৈরি করেছে তেমনি দর্শকদেরও কনটেন্টে বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত করেছে।