সালমান খান
সালমান খান

সাঁতার, রক্তদান—সিনেমার বাইরে সালমানের ১১ অজানা তথ্য

বলিউডের জনপ্রিয় তারকা আবদুল রশিদ সেলিম সালমান খান—এই দীর্ঘ নামেই তাঁর জন্ম হয় ১৯৬৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে। বাবা প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার সেলিম খান, মা সালমা খান।

চলচ্চিত্র অনুরাগী ও সৃজনশীল এক পরিবারে বেড়ে ওঠা সালমান খানের হাত ধরেই বলিউড পেয়েছে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি কখনো তারকাখ্যাতির ঝলক দেখিয়েছেন, কখনো বিতর্কের কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন, তবু মানুষের হৃদয় থেকে সরে যাননি কোনো দিনই।

শুরুর দিকে পার্শ্বচরিত্র দিয়ে বলিউডে পথচলা শুরু করেন সালমান। ‘বিবি হো তো অ্যায়সি’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে দেখা যায় তাঁকে। এরপর আসে তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিনেমা—‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’। প্রেম নামটা তখন স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় সালমানের সঙ্গে। সিনেমাটি শুধু ব্যবসাসফলই হয়নি; বরং নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে প্রেমের নতুন ভাষা লিখে দেয়। সেই শুরু, তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
অভিনয়ের মতো সালমানের ব্যক্তিজীবনও রঙিন, আলোচিত এবং নাটকীয়। বিতর্ক, আদালত, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, দাতব্য কাজ—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন যেন এক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। সালমান খান সম্পর্কে এমন কিছু জানা-অজানা তথ্য তুলে ধরা হলো—

স্কুলজীবনে বহুবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি

১. তুখোড় সাঁতারু ছিলেন সালমান
শুধু অভিনেতা নন, চাইলে জাতীয় পর্যায়ের সাঁতারু হিসেবেও নাম করতে পারতেন সালমান। স্কুলজীবনে বহুবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি।

ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে দেশের বাইরেও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন দারুণ অ্যাথলেটিক—দৌড়, সাঁতার, সাইক্লিং—সবকিছুতেই সমান স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাঁর। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সাঁতার ছেড়ে বেছে নেন পর্দার জীবন। আজ তিনি বলিউডের ‘সুলতান’, তবে একসময় সত্যিই তিনি হতে পারতেন ভারতের সেরা সাঁতারুদের একজন।

‘বজরঙ্গি ভাইজান’ সিনেমায় সালমান খান ও হর্ষালি। আইএমডিবি

২. ফিরোজা পাথরের ব্রেসলেট
সালমানকে খুব কমই দেখবেন ব্রেসলেট ছাড়া। ফিরোজা রঙের পাথর বসানো সেই ব্রেসলেট তাঁর কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক। শুধু তিনি নন, তাঁর বাবা সেলিম খানও সব সময় এ ধরনের ব্রেসলেট পরেন।
বলিউডের আলোঝলমলে জগতে সালমানের এই ব্রেসলেট যেন হয়ে উঠেছে এক বিশেষ পরিচয়। চলচ্চিত্রের সেটে, শুটিংয়ে, ইভেন্টে—সব জায়গাতেই তাঁর হাতে ঝুলতে দেখা যায় এই সৌভাগ্যের তাবিজ।

৩. ‘বাজিগর’ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন
বলিউড ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘বাজিগর’। এ ছবির নায়ক হওয়ার প্রস্তাব প্রথমে দেওয়া হয়েছিল সালমান খানকে। কিন্তু নেতিবাচক চরিত্র হওয়ায় তিনি ছবিটি করতে রাজি হননি।
পরে ছবিতে অভিনয় করেন শাহরুখ খান। শুরু হয় নতুন এক তারকার উত্থান। ভাগ্যের কী অদ্ভুত খেলা, এক তারকার জন্য ফিরিয়ে দেওয়া চরিত্রই আরেক তারকার পরিচয় গড়ে দেয়।

‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’ ছবিতে ‘প্রেম’ রূপে ঝড় তুলেছিলেন তিনি

৪. বাবুর্চিও নিয়ে গিয়েছিলেন লন্ডনে
সালমান খান ভীষণ ভোজনরসিক। ভারতীয় খাবারের প্রতি তাঁর আলাদা দুর্বলতা রয়েছে। ‘লন্ডন ড্রিমস’ ছবির শুটিংয়ে দীর্ঘদিন লন্ডনে থাকতে গিয়ে স্থানীয় খাবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি আর তাঁর টিম।
সমাধান?
নিজের বাবুর্চিকে লন্ডনে উড়িয়ে নিয়ে যান—শুধু বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য!
এ ছাড়া চায়নিজ খাবারের প্রতিও সালমানের আলাদা টান আছে। মুম্বাইয়ের ‘চায়না গার্ডেন’ তাঁর অন্যতম প্রিয় রেস্তোরাঁ। শুটিংয়ের ব্যস্ততার মধ্যেও সুযোগ পেলেই তিনি বন্ধুদের নিয়ে এখানে খেতে যান।

সিনেমার দৃশ্যে সালমান খান

৫. জুতার ব্র্যান্ডের দূত, বাসায় থাকেন খালি পায়ে
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জুতার দূতিয়ালি করলেও নিজের বাড়িতে খালি পায়েই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সালমান। তাঁর মতে, খালি পায়ে থাকলে নাকি তিনি নিজেকে প্রকৃতির আরও কাছাকাছি অনুভব করেন।
তারকাজীবনের চাকচিক্যের ভেতরেও সালমানের এই সরল অভ্যাস মানুষকে বিস্মিত করে। একই সঙ্গে আরও আপন করে তোলে তাঁকে।

৬. গাড়িপ্রেমী সালমান
গাড়ির প্রতি প্রবল টান আছে সালমানের। বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ থেকে শুরু করে ল্যান্ড ক্রুজার—দুর্লভ সব গাড়ি রয়েছে তাঁর গ্যারেজে। সুযোগ পেলে নিজেই ড্রাইভ করে বেরিয়ে পড়েন।
বলিউডে সালমানের গাড়ির সংগ্রহ নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত। বন্ধুদের উপহার হিসেবে বিলাসবহুল গাড়ি দেওয়ার নজিরও রয়েছে তাঁর।

‘চুলবুল পান্ডে’ চরিত্রে সালমান খান। আইএমডিবি

৭. ফলের নির্যাসে তৈরি সাবানেই ভরসা
সালমান খান প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি সাবান ব্যবহার করতে খুব ভালোবাসেন। বিশেষ করে ফলের নির্যাসে তৈরি সাবান তাঁর বেশি পছন্দ। তাঁর বাথরুমে নাকি রাখা থাকে নানা ধরনের ন্যাচারাল সাবান—লেবু, কমলা, বেরি; আরও কত–কী!
চমকপ্রদ হলেও সত্য, নিজের ত্বকচর্চা নিয়ে সালমান অত্যন্ত সচেতন।

৮. নিয়মিত রক্তদান ও দাতব্য কাজে জড়িত
চকচকে তারকাজীবনের আড়ালে আছেন আরেক সালমান—নীরব, সংযত ও মানবিক এক মানুষ। নিজের জনপ্রিয়তা আর প্রভাবকে সালমান শুধু বিলাস আর আলোচনার জন্য ব্যবহার করেন না; বরং মানুষের উপকারেও কাজে লাগান। বহু বছর ধরেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থা ‘বিয়িং হিউম্যান’ সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে আসছে। বিশেষ করে দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসাসহায়তা, হৃদ্‌রোগ ও জটিল অপারেশনের খরচ বহন, শিক্ষাসহায়তা, স্কলারশিপ, বই-খাতা-শিক্ষাসামগ্রী প্রদান, বিশেষ শিশুদের সহায়তা—এসব ক্ষেত্রেই সংস্থাটির কাজ চোখে পড়ার মতো।
পর্দার বাইরে ব্যক্তিজীবনে সালমান বরাবরই সাহায্যপ্রবণ হিসেবে পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে তিনি নিঃশব্দে, নাম প্রকাশ না করে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন—এমন উদাহরণও রয়েছে অসংখ্য। অসুস্থ শিল্পী, বিপদে পড়া সহশিল্পী, এমনকি সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসহায়তার ক্ষেত্রেও তাঁর এগিয়ে আসা নিয়ে বলিউডে বহু গল্প প্রচলিত।

সালমান খান

তারকা হয়েও সালমান নিয়মিত রক্তদান কর্মসূচিতে অংশ নেন, আর আশপাশের মানুষকেও এ কাজে উৎসাহিত করেন। তাঁর বিশ্বাস, তারকার দায়িত্ব শুধু দর্শককে বিনোদন দেওয়া নয়; বরং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা।

৯. প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবেও চমক
অনেকেই জানেন না, সালমান খান প্লেব্যাক সিঙ্গারও। ১৯৯৯ সালে ‘হ্যালো ব্রাদার’ ছবিতে ‘চান্দি কি ডাল পার’ গানে প্রথম কণ্ঠ দেন তিনি। এরপর ‘বডিগার্ড’-এর টাইটেল গানেও কণ্ঠ শোনা যায় তাঁর।

গায়কি মোটেই খারাপ নয়; বরং সালমানের কণ্ঠে রয়েছে একধরনের সরলতা, যা ভক্তদের কাছে আলাদা আবেদন সৃষ্টি করে।

আমির খান, সালমান খান ও শাহরুখ খান। এএনআই
জীবনের গল্প—সাফল্য, বিতর্ক, তবু নিরন্তর জনপ্রিয়তা

সাঁতার ছেড়ে সিনেমায় আসা এক তরুণ আজ হয়ে উঠেছেন বলিউডের কিংবদন্তি। সাফল্যের পাশাপাশি তাঁকে ছুঁয়েছে বিতর্ক, আইনি জটিলতা, ব্যক্তিজীবনের গুঞ্জন, সম্পর্কের ওঠানামা। কখনো মিডিয়ার তোপের মুখে পড়েছেন, কখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছেন।
তবু অদ্ভুতভাবে সালমান দর্শকের ভালোবাসা হারাননি। বরং দিনের পর দিন, বছর পেরিয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা যেন আরও বেড়েছে। হয়তো কারণ, মানুষ তাঁকে সিনেমার নায়ক হিসেবে যেমন চেনেন, তেমনি চেনেন প্রতিবেশীর মতো, আত্মীয়ের মতো—একজন পরিচিত, কাছের মানুষ হিসেবে।
‘কবে বিয়ে করবেন?’ এ প্রশ্ন নিয়েও বহুদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সালমান। তবু জীবনকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন সালমান।
বলিউডে সালমানের অভিনীত ছবির সংখ্যা আজ ১০০ ছাড়িয়েছে। অ্যাকশন, রোমান্স, কমেডি—সব ঘরানায়ই নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, ‘করণ অর্জুন’, ‘তেরে নাম’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, ‘সুলতান’, ‘কিক’—এমন বহু ছবিতেই তাঁর অভিনয় আজও মানুষের মনে তাজা।
ব্যক্তিত্ব, শরীরী ভাষা, স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়—সব মিলিয়ে সালমান খান হয়ে উঠেছেন এক আলাদা ঘরানার সুপারস্টার। তাই জন্মদিনে তাঁকে ঘিরে অগণিত মানুষের ভালোবাসা যেন আরও প্রবল হয়ে ওঠে—ভারতজুড়ে, উপমহাদেশজুড়ে, বিশ্বজুড়েই।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সালমান বলে এসেছেন যে পরিবারই তাঁর সবচেয়ে বড় ভরসা

১০. প্রিয় স্ট্যালোন, হেমা মালিনী
এ প্রজন্মের তারকাদের চেয়ে পুরোনো দিনের অভিনেতাদের প্রতিই সালমানের টান বেশি। তাঁর প্রিয় অভিনেতা সিলভেস্টার স্ট্যালোন, যাঁর অ্যাকশন অভিনয় তাঁকে প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত করে। আর প্রিয় অভিনেত্রীদের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছেন হেমা মালিনী।

জিমে নিয়মিত সময় কাটান সালমান

১১. ১ টাকায় এইচআইভি পজিটিভ তরুণের চরিত্রে অভিনয়
দীর্ঘ অভিনয়জীবনে পর্দায় অসংখ্য ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রে দেখা গেছে সালমান খানকে। আবার অনেক সময় তিনি এমন চরিত্রও বেছে নিয়েছেন, যেখানে নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলতে হয়েছে। তেমনই একটি সাহসী কাজ ছিল ‘ফির মিলেঙ্গে’ সিনেমায় তাঁর অভিনয়। সেখানে তিনি অভিনয় করেছিলেন এক এইচআইভি পজিটিভ তরুণের চরিত্রে, যে সময়ে বলিউডে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা ছিল সাহসের ব্যাপার। প্রেমের সিনেমার ভিড়ে এ ধরনের কনটেন্ট নিয়ে এগোতে চাননি অনেকেই। কিন্তু যুবসমাজকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে সালমান শুধু এ চরিত্রে অভিনয়ই করেননি, পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন মাত্র ১ টাকা।

ছবির প্রযোজক শৈলেন্দ্র সিংহর ভাষায়, বলিউডের সুপারস্টার হয়েও তিনি নিজের ভাবমূর্তির কথা না ভেবে এমন একটি চরিত্র করতে রাজি হয়েছিলেন, যার ক্লাইমেক্সে নায়কের মৃত্যু ঘটে। যেখানে অধিকাংশ তারকা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফ্রেমে থাকতে চান, সেখানে সমাজের স্বার্থকেই বড় করেছেন সালমান। শুধু পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও তাঁর মানবিকতা প্রশংসিত—নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন তিনি।