ভারতের সিনেমা–দুনিয়ায় অবিশ্বাস্য সব কাহিনি আছে, যেগুলো বলিউড সিনেমার চেয়েও কম রোমাঞ্চকর নয়। সেই তালিকায় থাকবে এই সময়ে আলোচিত তরুণ অভিনেতা হর্ষবর্ধন রানের নাম। ১৬ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে যাওয়া এক কিশোর আজ বলিউডের পরপর দুটি হিট ছবির নায়ক। একসময় দিনে ১০ রুপিতে কাজ করা সেই ছেলে এখন ১০০ কোটি রুপির ক্লাবের কাছাকাছি ছবির তারকা।
শুরুর গল্প
অন্ধ্র প্রদেশের রাজামহেন্দ্রবমে জন্ম রানের। বাবা মারাঠি, মা তেলুগু। শৈশব কেটেছে গোয়ালিয়রে। তাঁর বাবা চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু ছেলের আগ্রহ ছিল সম্পূর্ণ অন্য জায়গায়—অভিনয়ে। বাবার পথে হাঁটার বদলে ১৬ বছর বয়সেই মাত্র ২০০ রুপি পকেটে নিয়ে রানে বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে, স্বপ্ন একটাই—অভিনেতা হওয়া।
প্রথমে চলে যান দিল্লি। সেখানে জীবন শুরু হয় চরম কষ্টে। কখনো হোস্টেলের মেসে ওয়েটারের কাজ, কখনো এসটিডি বুথে রেজিস্টার লেখার দায়িত্ব—দৈনিক মজুরি ১০ রুপি। কখনো ক্যাফেতে কাজ পেলে পেতেন ২০ রুপি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘প্রথম লড়াইটা ছিল খাবার জোগাড় করা আর ১০ রুপির নিশ্চয়তা পাওয়া। তারপর আসে নতুন লড়াই—একটা পরিষ্কার বাথরুম খোঁজা। সাবানে অন্যের চুল লেগে থাকত। রাতে চার থেকে পাঁচজন পরিশ্রমী মানুষের সঙ্গে এক ঘরে ঘুমাতাম, সবার শরীরের ঘামের গন্ধ। প্রথম যখন কিছু টাকা জমাতে পারলাম, একটা পারফিউম কিনেছিলাম, আর ম্যাকডোনাল্ডসে গিয়ে একটা শেক খেয়েছিলাম।’
মুম্বাইয়ের গল্প
সেই সংগ্রামই ছিল রানের জীবনের মোড় ঘোরানোর সূচনা। কয়েক বছর পর তিনি চলে আসেন মুম্বাই—স্বপ্নের শহর, সিনেমার শহরে। এখানেই মেলে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ, টেলিভিশন ধারাবাহিক ‘লেফট রাইট লেফট’-এ। তখন প্রায় আট বছর কেটে গেছে বাড়ি ছেড়ে আসার পর। এরপর বড় পর্দায় অভিষেক ‘থাকিটা থাকিটা’ ছবিতে।
দ্বিতীয় ছবিতেই সহশিল্পী হিসেবে পান রানা দাগ্গুবতি ও জেনেলিয়া দেশমুখকে। ‘নাইশতাম’ ছবিটি রানেকে নজরে আনে। তারপর আর থামতে হয়নি। প্রতিবছর একাধিক ছবিতে কাজ করতে থাকেন।
২০১৬ সালে রানে পা রাখেন বলিউডে, ‘সনম তেরি কসম’ দিয়ে। ছবিটি বক্স অফিসে খুব বড় সাফল্য না পেলেও দর্শকের ভালোবাসা পায় প্রচুর—এতটাই যে প্রায় এক দশক পর ছবিটি পুনরায় মুক্তি পেয়ে ৫৩ কোটি রুপি আয় করে নেয়। সেই ছবিই হয়ে ওঠে রানের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।
মানুষের পাশে
তবে জনপ্রিয়তার মধ্যেও মানবিক রানে ভুলে যাননি নিজের শিকড়। করোনা মহামারির সময় তিনি নিজের প্রিয় মোটরসাইকেল বিক্রি করে সেই টাকায় অক্সিজেন কনসেনট্রেটর কেনেন অসহায় মানুষের জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন, ‘আমার মোটরসাইকেলটি দিচ্ছি, বদলে পেতে চাই কয়েকটি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। একসঙ্গে আমরা হয়তো কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারব।’
রানের একটি দাতব্য সংস্থা রয়েছে, যেখানে তিনি শার্ট অব চ্যালেঞ্জ চালু করেছেন—ছবিতে পরা নিজের টি-শার্ট বিক্রি করে সেই অর্থ ব্যয় হয় প্রয়োজনীয় মানুষের জন্য। ২০১৫ সাল থেকে এ উদ্যোগের অর্থ দিয়ে একটি মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে রানে বলেন, ‘আমি ভাবলাম, আমার জামাগুলো যদি নোটবুকে পরিণত হয়, তাহলে হয়তো একটা মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। আগে ভাবতাম অনাথ আশ্রমে আসবাব দেব, কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত ছিল না। পরে ভাবলাম কাপড় দেব, তাতেও তেমন কাজ হবে না। তাই ভাবলাম, গ্যারেজ সেলে জামা বিক্রি করব, আর সেই টাকায় মেয়েটার পড়াশোনা চলবে।’
‘এক দিওয়ানি কি দিওনিয়াত’–এর সাফল্য
এখন রানে উপভোগ করছেন তাঁর সর্বশেষ ছবি ‘এক দিওয়ানি কী দিওনিয়াত’-এর সাফল্য। মিলাপ জাভেরি পরিচালিত এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে আছেন সোনম বাজওয়া, শাদ রন্ধাওয়া ও শচীন খেদেকর। গত ২১ অক্টোবর মুক্তির পর থেকেই ছবিটি বক্স অফিসে চমক দেখাচ্ছে—মাত্র কয়েক সপ্তাহে আয় ৫৯ কোটি রুপি। এখন সবার নজর, সেটি কি ১০০ কোটির গণ্ডি ছুঁতে পারবে?
১৬ বছর বয়সে ২০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া এক ছেলের জন্য এই অর্জন নিঃসন্দেহে সিনেমার চেয়েও বড় এক গল্প, যেখানে অধ্যবসায়, কষ্ট আর আত্মবিশ্বাস মিলে গড়ে দিয়েছে এক অনন্য সাফল্যের যাত্রা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অবলম্বনে