
বলিউডে গত বুধবার রাতে হামলার শিকার হয়েছেন সাইফ আলী খান। বলিউডে এমন ঘটনা একেবারে নতুন নয়। গত বছর সালমান খান ও শাহরুখ খানকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি সালমান খানের বাড়িতে গুলিও চালানো হয়েছে। বলিউডের সঙ্গে মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের যোগ নিয়ে লিখেছেন সুমন মাহমুদ
সালমান খানের বাড়িতে গুলির ঘটনার পরেই তারকাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেক তারকা নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। সালমান খানের পর শাহরুখ খান; এরপর কঙ্গনা রনৌত, বিক্রান্ত ম্যাসি, সাইফ আলী খান—তালিকা ক্রমাগত বড় হচ্ছে। এই তারকারা যখনই হুমকি কিংবা হামলার সম্মুখীন হয়েছেন, তখনই তা খবরে এসেছে। শাহরুখ খানের কথাই ধরা যাক। গত ৫ নভেম্বর মুম্বাইয়ের বান্দ্রা পুলিশ স্টেশন একটি ফোনকল পায়, যেখানে শাহরুখ খানকে হত্যার হুমকি দিয়ে ৫০ লাখ রুপি চাঁদা দাবি করা হয়। অভিযান চালিয়ে ফাইয়াজ খান নামের এক আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
অন্যদিকে লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের কাছ থেকে পঞ্চমবারের মতো হত্যার হুমকি পেয়েছেন সালমান খান। সেই সঙ্গে মুম্বাই ট্রাফিক পুলিশের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঁচ কোটি টাকার চাঁদা চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছে বিষ্ণোই গ্যাং।
হত্যার হুমকি শুধু বড় তারকাদের ক্ষেত্রেই ঘটছে, ব্যাপারটা এমন নয়, বাদ যাচ্ছেন না উদীয়মান তারকারাও। বিক্রান্ত ম্যাসি তাঁর নতুন সিনেমা দ্য সবরমতী রিপোর্ট-এর ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের কাছে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা জানান। আর অভিনেত্রী ও সংসদ সদস্য কঙ্গনা রনৌতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি খুব বেশি দিন আগের নয়। কঙ্গনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, তাঁর নতুন সিনেমা ইমার্জেন্সি মুক্তি দেওয়া নিয়ে হুমকি পেয়েছেন।
আসলে বলিউড আর অপরাধজগতের যোগ নতুন নয়। একটি সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নানা সময়ে বলিউডে অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে। ইন্ডাস্ট্রির একদম ভেতরে ঢুকে নেটওয়ার্কটি কাজ করে। প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয়শিল্পীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যেসব তারকা তাঁদের কাজের মাধ্যমে খ্যাতি লাভ করতে শুরু করেন, তাঁরাই হয়ে ওঠেন এই নেটওয়ার্কের সহজ লক্ষ্য। ১৯৬০-এর দশক থেকেই মুম্বাইয়ের অপরাধজগৎ বলিউডের সঙ্গে এক সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে, যার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি, হত্যা ও হত্যার হুমকির ঘটনা ঘটেছে।
যোগাযোগের শুরু
বলিউডের রঙিন দুনিয়ার সঙ্গে অপরাধজগতের যে যোগাযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তা প্রকাশ্যে আসে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এক ব্যক্তি বলেন, সেই ১৯৭০-এর দশকে বলিউডের সঙ্গে অপরাধজগতের যোগাযোগ তৈরি হয়। হাজি মাস্তান ও করিম লালার মতো ডনদের বলিউডের হাই প্রোফাইল পার্টিগুলোতে উপস্থিত হতে দেখা যায়। সে সময় বলিউডে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়াকে মাফিয়ারা প্রভাব বিস্তারের চেয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির নির্দেশক হিসেবেই বেশি বিবেচনা করতেন।
তিনি আরও বলেন, হাই প্রোফাইল তারকাদের নিশানা বানিয়ে চাঁদা দাবি এবং হত্যার হুমকি দেওয়া অপরাধজগতে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করার একটি নতুন উপায় হয়ে ওঠে। কারণ, এমনটা করতে পারলে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হয়। শুরুর দিকে বলিউড আর অপরাধজগতের যোগাযোগ উভয় পক্ষকেই (এক পক্ষে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, অপর পক্ষে আধিপত্য বৃদ্ধি) লাভবান করলেও পরে দ্রুত ঘটনার মোড় ঘুরে যেতে থাকে।
১৯৯৩ সালে বোম্বের ভয়াবহ বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত ও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক ভারত শাহকে গ্রেপ্তার করা হয়। শোনা যায়, ভারত শাহর সঙ্গে নাকি গ্যাংস্টার ছোটা শাকিলের যোগাযোগ ছিল। এখানেই শেষ নয়, টি-সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা গুলশান কুমারকে ১৯৯৭ সালে এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক মুকেশ দুগ্গালকে ১৯৯৮ সালে হত্যার মাধ্যমে মুম্বাইয়ের অপরাধজগৎ তার প্রভাববিস্তারী ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলিউড ও অপরাধজগতের যোগসূত্র নিয়ে যখন এত আলোচনা হচ্ছে, তখন ইন্ডাস্ট্রির ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র বলছে, অধিকাংশ তারকারই অপরাধজগতের নেটওয়ার্কের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। আবার অনেক তারকা প্রকাশ্যে এড়িয়ে চললেও ভেতরে-ভেতরে ঠিকই মৌন সমর্থন দিয়ে চলেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে হুমকির অভিযোগ নিয়ে গেলে ব্যাপারটি তাঁরা মেনে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পাল্টা ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে ওই কর্মকর্তারা সতর্ক করেন।’
ফলে নিজেরাই এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদারের দিকে মনোযোগী হয়েছেন তারকারা। এই যেমন হত্যার হুমকি পাওয়ার পর ২০২২ সালে বন্দুকের লাইসেন্স নিয়েছেন সালমান খান। শাহরুখ খান দেহরক্ষী আর বুলেটপ্রুফ গাড়ির মাধ্যমে বাড়িয়ে নিয়েছেন নিজের নিরাপত্তা। আরেক তারকা অজয় দেবগন কঠোর করেছেন তাঁর নিরাপত্তাব্যবস্থা। কিনেছেন বুলেটপ্রুফ গাড়ি।
যত ঘটনা
১৯৬০
মুম্বাইয়ের অপরাধজগতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন ডন হাজি মাস্তান।
১৯৮০
বলিউডের সঙ্গে মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিম ঘনিষ্ঠতা।
১৯৯৩
বোম্বে বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সঞ্জয় দত্ত গ্রেপ্তার।
১৯৯৭
চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় টি-সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা গুলশান কুমারকে গুলি করে হত্যা।
১৯৯৮
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক মুকেশ দুগ্গালকে নিজ কার্যালয়ের সামনে হত্যা।
২০০০
অভিনেতা হৃতিক রোশনের বাবা নির্মাতা ও প্রযোজক রাকেশ রোশনকে হত্যাচেষ্টা।
২০০১
অপরাধজগতে অর্থায়নের দায়ে চোরি চোরি চুপকে চুপকে সিনেমার প্রযোজক নাজিম হোসেন রিজভি গ্রেপ্তার।
২০১৮
সালমান খানকে গ্যাংস্টার লরেন্স বিষ্ণোইয়ের হত্যার হুমকি।
২০২৪
শাহরুখ খান, সালমান খানের কাছে চাঁদা দাবি। সালমান খানের বাসায় গুলি। শাহরুখ খানকে হত্যার হুমকি।
২০২৫
সাইফ আলী খানের ওপর সরাসরি হামলা। তবে এ ঘটনার পেছনে মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের হাত রয়েছে কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া