সারিকা। আইএমডিবি
সারিকা। আইএমডিবি

সমাজের চোখে ‘মন্দ নারী’, সারিকার জীবনের গল্প সিনেমাকে হার মানায়

বলিউডের জনপ্রিয় এই অভিনেত্রীর জীবন সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই নাটকীয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা ছেড়ে চলে যান; সংসারের হাল ধরতে শৈশবেই কাজ শুরু করেন। বড় হয়ে খ্যাতি পেয়েছেন, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রটেছে নানা গুঞ্জন; সব মিলিয়ে তিনি ভারতীয় সিনেমার এক আলোচিত চরিত্র।

সারিকা আজও নিজের জীবন, অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তের প্রতি একেবারে সৎ। অভিনয় হোক বা থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ, মা হওয়া হোক বা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে—সবকিছুই তাঁর জীবনের অংশ। নিজের নিয়মে বাঁচা, নিজের ছন্দে জীবন—এটাই সারিকার দর্শন।

জীবনের শুরুতেই ঝড়
বাবা ছেড়ে গিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। সেই বয়সে যখন অন্য বাচ্চারা স্কুলে ভর্তি হয়ে খেলার ছলে পড়াশোনা শুরু করে, তখন থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাঁকে। জীবনের শুরুতেই হারিয়ে যায় শৈশবের নির্ভারতা, নিষ্পাপ আনন্দ। তিনি আর কেউ নন, অভিনেত্রী সারিকা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যাঁর নাম উচ্চারিত হলে ভেসে ওঠে এক অদ্ভুত মিশ্রণ—শৈশবের হারানো দিন, প্রেম-অপ্রেম, কেলেঙ্কারি আর জীবনের বিরুদ্ধে লড়াই।

শিশুশিল্পী হিসেবে শুরু
পাঁচ বছর বয়সেই চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ। সুনীল দত্তের ১৯৬৭ সালের ছবি ‘হামরাজ’-এ ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। একটুকরা নিষ্পাপ শৈশবের বিনিময়ে তিনি হয়ে ওঠেন পরিবারের উপার্জনকারী। পরে এক সাক্ষাৎকারে সিমি গাড়োয়ালকে বলেন, ‘আমি কখনো স্কুলে যাইনি। একবার আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় আর যাওয়া হয়নি। আজও আফসোস করি—শৈশবটা হারিয়ে গেছে। শিশু বয়সে যে স্বাধীনতা থাকে, তা আর কোনো দিন ফিরে পাওয়া যায় না।’

শিশুশিল্পী হিসেবে সারিকাকে অভিনয় করতে হতো ভীষণ আবেগঘন ও কষ্টের দৃশ্যে। আইএমডিবি

শিশুশিল্পী হিসেবে সারিকাকে অভিনয় করতে হতো ভীষণ আবেগঘন ও কষ্টের দৃশ্যে। কখনো মা–বাবা হারানোর কান্না, কখনো মৃত্যুর শোক। সারিকার কথায়, ‘গ্লিসারিন লাগিয়ে খারাপ কথা বলত, যেন আমি কাঁদি। তখন আমাদের ছয় বছরের বাচ্চাদের দিয়ে এই ট্র্যাজেডি অভিনয় করানো হতো। দৃশ্য ভালো হলে পুরস্কার ছিল বিস্কুট আর চকলেট।’

তরুণ বয়সের সংগ্রাম
১৫ বছর বয়সে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সারিকা। পর্দার সামনে জীবন যখন আলোকোজ্জ্বল মনে হচ্ছিল, তখনই ২১ বছর বয়সে তিনি ছেড়ে আসেন ঘর, সঙ্গে ছিল মাত্র ৬০ রুপি আর একটি গাড়ি। একরাশ অভিমান, কিছুটা স্বপ্ন আর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটা হঠাৎ নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। অনেক ভেবেচিন্তেই একদিন মনে হয়েছিল, আর নয়।’

কপিল দেব ও সারিকার পরিচয় হয়েছিল অভিনেতা মনোজ কুমারের স্ত্রীর মাধ্যমে। তখন দুজনই অবিবাহিত। প্রথম দিকে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একে অপরের প্রতি আকর্ষণও ছিল স্পষ্ট। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই কপিল সিদ্ধান্ত নেন এই সম্পর্ক শেষ করার। রোমি ভাটিয়ার সঙ্গে কপিল দেবের সম্পর্ক ঠিকভাবে চলছিল না। এই সময়ে তিনি সারিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি রোমিকেই বিয়ে করেন।

জীবন তখন সহজ ছিল না। বন্ধুদের বাড়িতে স্নান করে রাতে গাড়ির ভেতর ঘুমাতেন। ‘যখন সত্যিই বাঁচার প্রয়োজন হয়, তখনই ভেতর থেকে সাহস চলে আসে,’ বলেন সারিকা।

সারিকা। আইএমডিবি

২০১৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর জুহুর ফ্ল্যাট নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই করতে হয় সারিকাকে। অভিযোগ ওঠে, মাকে ১৯৮২ সালেই ত্যাগ করেছিলেন সারিকা। আর তাঁর মৃত্যুর পর সেই ফ্ল্যাট অবৈধভাবে দখল করতে চাইছেন। তবু লড়াই চালিয়ে যান তিনি।

কপিল দেবের সঙ্গে প্রেম
কপিল দেব ও সারিকার পরিচয় হয়েছিল অভিনেতা মনোজ কুমারের স্ত্রীর মাধ্যমে। তখন দুজনই অবিবাহিত। প্রথম দিকে তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একে অপরের প্রতি আকর্ষণও ছিল স্পষ্ট। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই কপিল সিদ্ধান্ত নেন এই সম্পর্ক শেষ করার। রোমি ভাটিয়ার সঙ্গে কপিল দেবের সম্পর্ক ঠিকভাবে চলছিল না। এই সময়ে তিনি সারিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি রোমিকেই বিয়ে করেন।

কমল হাসান অধ্যায়
এই সময়ে জীবনে আসে কমল হাসান। ১৯৮৪ সালে ‘রাজ তিলক’ ছবির শুটিংয়ে তাঁদের দেখা। প্রথমে বন্ধুত্ব, পরে টান, তারপর প্রেম। কিন্তু পথ ছিল কাঁটায় ভরা। তখনো কমল হাসানের স্ত্রী ছিলেন নৃত্যশিল্পী বাণী গণপতি। একদিকে সমাজের চোখরাঙানি, অন্যদিকে নিজেদের ভেতরের টানাপোড়েন।

বিয়ের পর সারিকা ও কমল হাসান। ইনস্টাগ্রাম থেকে

সারিকার ভাষায়, ‘আমাদের টান ছিল, কিন্তু সেই টান মানতে ভয় পেতাম। একসময় বুঝলাম, ভালোবাসা শুধু সুখের সময়েই নয়, খারাপ সময়েও টিকে থাকে।’
কমল হাসান এ প্রসঙ্গে আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রথমে আমরা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বারবার একই ঝড়ে ভেসে যাচ্ছিলাম। অবশেষে প্রেমে পড়লাম।’

সমাজের চোখে ‘মন্দ নারী’
প্রেম গোপন রাখা গেল না। তখনই জানা গেল, সারিকা সন্তানসম্ভবা। প্রথম কন্যা শ্রুতি হাসান জন্ম নিলেন ১৯৮৬ সালে। কিন্তু এই সম্পর্কের জন্য তাঁরা তীব্র সমালোচনার শিকার হন। সমাজের চোখে সারিকা হয়ে গেলেন ‘মন্দ নারী’। নিজেও এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি শুধু তাঁকে জানিয়েছিলাম, আমি সন্তান ধারণ করেছি। আমি কখনো বলিনি, স্ত্রীকে ছেড়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে। এটা ছিল আমার সিদ্ধান্ত।’

মেয়েরা আমার বন্ধু। বয়সে ছোট বলে তাদের সম্মান না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। দুই কন্যাই আলাদা ধরনের বন্ধু, আলাদা ব্যক্তিত্ব। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক।
সারিকা

কমল হাসান মনে করলেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না। সাংবাদিকদের ডেকে তিনি প্রকাশ্যে জানালেন, ‘এই সন্তান আমার।’ তারপরও সহজ হয়নি জীবন। ভাড়া বাসা পাওয়া ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। চেন্নাই শহরে তাঁরা হয়ে ওঠেন আলোচিত এক চরিত্র।
দ্বিতীয় কন্যা অক্ষরা জন্ম নিল ১৯৯১ সালে। তখনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন কমল-সারিকা। কিন্তু বিয়ের পরও সারিকার মনে দ্বিধা রয়ে গিয়েছিল। তাঁর ভাষায়, ‘বিয়ে হয়তো দরকারি, কিন্তু দুজন মানুষকে একসঙ্গে রাখতে পারে না। আজ আমরা আছি, কাল না–ও থাকতে পারি।’ ২০০৪ সালে সত্যি সত্যিই বিচ্ছেদ ঘটে তাঁদের।

মেয়ের চোখে, মায়ের চোখে
মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে শ্রুতি হাসান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটা বেদনাদায়ক। কিন্তু অশান্তির সংসারের চেয়ে আলাদা হওয়া অনেক ভালো। যখন তাঁরা একসঙ্গে সুখে ছিলেন, তখন তাঁদের জুটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছিল। কিন্তু একসঙ্গে থাকা না গেলে আলাদা হওয়াই শ্রেয়।’

দুই কন্যা শ্রুতি ও অক্ষরার সঙ্গে কমল হাসান ও সারিকা। ইনস্টাগ্রাম থেকে

দুই কন্যা শ্রুতি ও অক্ষরা হাসানের সঙ্গে মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁদের নিয়ে সারিকা বলেন, ‘মেয়েরা আমার বন্ধু। বয়সে ছোট বলে তাদের সম্মান না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। দুই কন্যাই আলাদা ধরনের বন্ধু, আলাদা ব্যক্তিত্ব। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক।’

সুখ তখনই, যখন আপনি সত্যিই সুখী হতে চান। যা আনন্দ দেয় না, তাতে না যান। নিজের খুশিতে জীবন কাটান, কাউকে আঘাত না দিয়ে মজা করুন।
সারিকা

‘আমি গর্বিত’
অভিনয়ে পাঁচ দশকের বেশি কাটিয়ে দিয়েছেন সারিকা। তাঁকে নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও অতীত নিয়ে আফসোস নেই তাঁর; কখনো নতুন শুরু করার বিশ্বাসী নন ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেত্রী। বরং জীবনকে তিনি নিজের মতো সাজাতে চান। ‘আমি আজ যে পর্যন্ত এসেছি, সে জন্য গর্বিত। আমার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত আমাকে এই পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে,’ টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এভাবেই বলেন সারিকা।

সারিকা মনে করেন, শৈশব হারানো জীবনের একটি বড় ক্ষতি। কাজের জন্য স্কুলে যাওয়া হয়নি, কিন্তু অভিনয় শিখেছেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় অভিভাবক হারানোর দুঃখ ভীষণ। তবে এরপর যা কিছু ঘটেছে, সবই আমাকে আজকের সারিকা বানিয়েছে।’

সারিকা। আইএমডিবি

সুখের মন্ত্র
সারিকার জীবনদর্শন স্পষ্ট, ‘সুখ তখনই, যখন আপনি সত্যিই সুখী হতে চান। যা আনন্দ দেয় না, তাতে না যান। নিজের খুশিতে জীবন কাটান, কাউকে আঘাত না দিয়ে মজা করুন।’ সারিকা আজও নিজের জীবন, অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তের প্রতি একেবারে সৎ। অভিনয় হোক বা থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ, মা হওয়া হোক বা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে—সবকিছুই তাঁর জীবনের অংশ। নিজের নিয়মে বাঁচা, নিজের ছন্দে জীবন—এটাই সারিকার দর্শন।

তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অব ইন্ডিয়া